সংশয়ে সন্তাপে শোকে এ পরবাসে রবে কে হায়!

তপন মল্লিক চৌধুরী,

পরিব্রাজক ইবনে বতুতা একদা বলেছিলেন, পর্যটক ভ্রমণকেন্দ্রে পৌঁছে প্রথমে হতবম্ব হয়, তারপর নাকি সে কথা বলতে শুরু করে; ভ্রমণকথা, গল্পকথা তার নিজের এবং আশপাশের কথা। ভ্রমণের মাঝে অনেকেই খোঁজেন গল্প-গাথা। খুঁজেছিলেন সত্যজিৎ রায়ও। তাই কখনো তাঁর সিনেমা ইউনিট নিয়ে হাজির হয়েছেন পালামৌতে বনের ধারে কোনও এক ডাক বাংলোতে কিংবা কাঞ্চনজঙ্ঘার পাহাড় আর লেপচাদের মাঝে অপরূপ এক পরিবেশে। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে কখনো আবার একান্ত পারিবারিক সফর। কিন্তু ঘটনা যাই হোক না কেন তা সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে পর্দায়। উপজীব্য ভ্রমণ থেকে তৈরি হতে দেখেছি অরণ্যের দিনরাত্রি ১৯৭০ সালে, তারও আগে ১৯৬২তে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সত্যজিতের কাঞ্চনজঙ্ঘা বাংলা প্রথম রঙিন ছবি।

কথায় বলে দেওয়ালেরও কান আছে। পাহাড়ের কি নেই? হয়ত সে কারণেই ইন্দ্রনাথ রায় পরিবারের সমস্ত সদস্যরা কাঞ্চনজঙ্ঘায় বেড়াতে এসে নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে একেবারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে, খোলাখুলি আলাপ-আলোচনা চালায় যেন সেসবের একটা নিরসন হোক এমনটা ভেবেই। সত্যজিত এ ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন নিজেরই গপ্প থেকে। সেদিক থেকেও সত্যজিৎ রায়ের মৌলিক চিত্রনাট্যের প্রথম ছবি কাঞ্চনজঙ্ঘায়। কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতের কাছে অবস্থিত এ রাজ্যের একমাত্র শৈলশহর ও জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র দার্জিলিঙে সপরিবারে ছুটি কাটাতে যাওয়া একট উচ্চবিত্ত বাঙালি পরিবারের কথা। আপাদমস্তক চলচিত্র হওয়া স্বত্বেও আমরা এগতে পারি রায় পরিবারের গল্পের পিছু পিছু।

এই রোদ, এই মেঘ, এই কুয়াশা- কাঞ্চনজঙ্ঘা বলতে আমারা এমনই এক পরিবেশকেই দেখতে পাই। অনুজ্জ্বল রোদ থেকে মেঘ আচ্ছন্ন আকাশ তারপর ধীরে ধীরে কুয়াশার কবল, চারপাশের চেনা জানা দৃশ্য কুয়াশায় কেমন অস্পষ্ট হয়ে যায়। প্রতীকী এবং রূপক দুই অর্থ এবং ভাবের হিমালয় বা কাঞ্চঞ্জঙ্ঘাকে পশ্চাৎপটে রেখে সত্যজিৎ হাজির করেন ইন্দ্রনাথ, লাবণ্য, মনীষা, অনিল, অনিমা, ব্যানার্জি, অশোক, জগদীশ, হরিধন, শংকর প্রমুখ চরিত্রগুলি। এদের পারস্পরিক সম্পর্ক,  জটিলতা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সবকিছুই যেমন ফুটে ওঠে শৈলশহরের বিষণ্ণ, বিরহ, রিক্ত, শুস্ক, শূণ্য প্রকৃতির আধারে তেমনই প্রকৃতির  শব্দহীনতা, দীর্ঘশ্বাস, মেঘ-কুয়াষা-পাহাড়ের আবহে বন্দী চরিত্রগুলির অতৃপ্ত অনুভূতি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ঔপনিবেশিক অভিজাততন্ত্রে বিশ্বাসী ইন্দ্রনাথ রায় তার মেয়ে মনীষার বিয়ে দিতে চান নিজের পছন্দ অনুসারে, একই শ্রেণির বড়লোক পাত্রের সঙ্গে। অন্যদিকে আমরা এও দেখতে পাই, ইন্দ্রনাথের পছন্দে বিয়ে হওয়া তার বড় মেয়ের সংসারের জটিলতা এমনকি তার বখে যাওয়া পুত্রের কাণ্ডকারখানা। এদিকে পরিবারের সবাই অপেক্ষা করে আছে উপর্যুক্ত পাত্র মিস্টার ব্যানার্জির সঙ্গে মনীষার আলাপচারিতা কতটা ফলপ্রসূ হয়। পাশাপাশি মনীষার সঙ্গে পরিচয় হয় কলকাতা থেকে চাকরির সন্ধানে আসা অশোকের। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বাবার পছন্দের প্রতিষ্ঠিত পাত্রকে পছন্দ না করে মনীষার কলকাতার চালচুলোহীন যুবক অশোককে ভালো লেগে যায়। ওদিকে ইন্দ্রনাথ রায়ের অসুখী প্রথম কন্যা অনিমা ও তার স্বামীর বহু বছরের সাংসারিক দ্ব›দ্বও মিটে যায় এই সফরকে ভিত্তি করেই। ওদিকে ব্রিটিশপ্রেমী ইন্দ্রনাথ রায়ের মুখের ওপর চাকরির আশায় থাকা যুবক অশোক চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

বহুদিন পর লাবণ্যের কণ্ঠ থেকে আপনিই যেন গান বেরিয়ে আসে-এ পরবাসে রবে কে হায়!/ কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে ॥ হিমালয়ের চূড়ায় বসেই কি তবে  লাবণ্য জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব খুঁজে পায়?  নাকি অনেক দিনের চাপা পড়া দুঃখ-ভয়-বেদনা  এমনভাবেই জেগে ওঠে! সে আর মুখ বুজে সব সহ্য করবে না। প্রয়োজনে দাম্ভিক-রক্ষণশীল স্বামীর বিরুদ্ধে লড়বে। রক্ষণশীল চিন্তার বেড়াজালে পিষ্ট নিজের জীবনের পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না। নিজের মেয়ের ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য সে লড়বে।

এক সফরে এতগুলি মানুষের অন্তরের ছবি এমনভাবে দেখতে পাওয়া, তাদের ভিতরের ঘুমিয়ে পড়া মানুষটির ফের  ঘুম থেকে জেগে উঠে বসা- সবই পাহাড়ের কোলে, পাহাড়ী পরিবেশে, রোদ-কুয়াষা-ছায়া-আবছায়ায় যেন বিষণ্ণ প্রকৃতির কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া আবার তার কাছেই উত্তর চাওয়া। একা লাবণ্য নয়, যেন সবাই সংশয় ফেলে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে বলে ওঠে –সবই যদি মুখ বুজে সহ্য করি তবে বেঁচে থেকে লাভ কি? 

4 Comments

  1. এই ছবিটি নিয়ে আলোচনা ভীষণ কম, তবে এই লেখাটির গভীরতা রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*