অন্যপ্রেম

মৌ দাশগুপ্তঃ

পার্বতীয়া জাতে মেথর। সারাদিন এর তার ঘরের ময়লা পরিস্কারেই সময় যায়। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে স্নান করাটা ওর বেশ দামী বিলাসিতা। মাথায় ফুলের গন্ধওয়ালা তেল, সুগন্ধি সাবান।স্নানের পর পরিস্কার কাঁচা একটি শাড়ি। তখন পার্বতীয়াকে যেন চেনাই যায়না। দেখতে খুব সুন্দর পার্বতীয়া। ওদের জাতে অমন সুন্দরী বিরল, তবে প্রচণ্ড মুখরা আর মারকুটে। পাঁচনম্বর মরদটাতো ওর পিটানি সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে গেছিল, তার আগেরটা নাকি ওর কথার জ্বালাতেই টিঁকতে পারেনি, তিননম্বরে যে ছিল সে তো বিষমদ খেয়ে মরে বেঁচেছে, দু’নম্বর মরদটা কাকে যেন মারধোর করে জেলে যাওয়ায় পার্বতীয়াই ওর সংসারে লাথি মেরে চলে এসেছে। এখন পার্বতীয়ার মরদের নাম দাশুয়া। এটা হল গিয়ে ওর ছ নম্বর বিয়ে।

দাশুয়া বয়সে বেশ ছোট, প্রায় পার্বতীয়ার বড় ছেলে অর্জুনের বয়সী। সারাদিন ই নেশার ঘোরে কাত হয়ে পড়ে থাকে, কাজকর্ম কিছুই করে না, পার্বতীয়াই ওকে খাইয়ে পরিয়ে রাখে।অবশ্য ওর পুষ্যির সংখ্যা বিশেষ কম নয়, ছয় ছয়টি স্বামীর তরফে গোটা আটেক বাচ্চাকাচ্চা, তা ছাড়াও একটা বুড়ো ঘাড়কুঁজো লোককেও সকাল -সন্ধ্যা, গ্রীষ্ম- শীত, ওদের বস্তির চালাঘরের বাইরে ঝিম খেয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। সকালে কাজে বার হবার সময় পার্বতীয়াই ওকে ঘরের দাওয়ায় বসিয়ে দিয়ে যায়, সারাদিন লোকটা ওখানে বসেই ঝিমোয়। কথাবার্তা-ও বিশেষ বলে না, বা বল্লেও ওর জড়ানো কথা পার্বতীয়া ছাড়া কেউ বিশেষ বোঝে বলে মনে হয়না।অর্জুন বা ওর পরের দুই বোন সুরতীয়া সরবতিয়া এসে মাঝেমধ্যে খাইয়ে দেওয়া বা প্রাকৃতিক কাজে নিয়ে যাবার মত কাজগুলো করিয়ে দেয়।ওরা বুড়ো স্থবিরপ্রায় লোকটাকে জগদীশিয়া বলেই ডাকে।

মেথর বস্তিতে কারো না কারো ঘরে ঝগড়াঝাঁটি মারপিট নিত্তনৈমত্তিক ঘটনা, এক বাড়িতে হয়, পড়শিরা মজা লুটতে আসে,মাঝে মধ্যে নিজেরা জড়িয়েও  পড়ে।বেশীর  ভাগ ক্ষেত্রে  ছেলেগুলোই  হাত চালায় আর মেয়েগুলো গলাবাজি করে,অল্প কিছু ব্যাতিক্রমীও আছে পার্বতীয়ার মত। ওর হাত পা মুখ সব সমানতালে চলে। সেদিন পার্বতীয়ার ঘরেই প্রচন্ড হৈ চৈ। দাশুয়া সকালে পচাই খাওয়ার টাকা পায়নি, আগের রাতে খুব মাতলামো করায় দু চার ঘাও খেয়েছে, পার্বতীয়া কাজে বেরিয়ে যাবার পর ছেলেমেয়েগুলোকে পিটিয়ে পাটিয়ে যা পয়সাকড়ি  পেয়েছে তাতে নেশা তো চড়েই নি উলটে চটে গেছে।ধারবাকিতেও ম্যানেজ হয়নি। ঘরে এসে বাসনপত্র নিয়ে গিয়ে বাঁধা দেবে ভেবেছিল, সুরতিয়া আর সর্বতিয়া এককেবারে মায়ের মেয়ে, ওখানে কাজ হয়নি,রাগের মাথায় বেরোবার মুখে জুবুথুবু হয়ে বসে থাকা জগদীশকেই মেরেছে এক লাথি।সে ছিটকে পড়ে হাউমাউ করে উঠতে না উঠতেই আরো দু চার ঘা বসিয়ে দিয়েছে। অর্জুন ঘরে ছিলনা, আশেপাশের লোক মজা দেখছিল।কিন্তু মার খেতে খেতে জগদীশের নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরোতে শুরু করায় সবাই মিলে যখন দাশুয়াকে সরিয়ে নেয় ততক্ষনে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছে বেচারা।সুরতিয়া ছুটে এসে মাথাটা কোলে তুলে নিতেই মুখ দিয়ে ঝলকে ঝলকে রক্ত,ভয়ে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে বাচ্চাদের। অবস্থা বেগতিক দেখে দাশুয়া পগাড়পার।

খবর পেয়ে পার্বতীয়া এসে পৌঁছানোর আগেই সব শেষ। পার্বতীয়ার কে হত লোকটা জানা নেই কারোরই, কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না ওর মধ্যে।পাত্তাই দিল না ব্যাপারটা। পুলিশ এল, কিন্তু জগদীশের নাকি যক্ষ্মারোগ ছিল, আরো অনেক রোগের ঢিপি ছিল।সে যাই হোক, পুলিশও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করল না। সব থিতিয়ে পড়লে সপ্তাহদুয়েক পরে নি:শব্দে বস্তিতে পা রাখলো দাশুয়া।সন্ধ্যায় স্নানবিলাসের পর পার্বতীয়া রোজকার মত তার নেশায় মশগুল। মেথরবস্তির কমন মদের আড্ডায় তখন বেশ ভিড়, দাশুয়ার তখন নেশার তেষ্টায় প্রাণ আইঢাই।সেও গুটিগুটিপায়ে সেখানে হাজির।পার্বতীয়া বেশ স্ত্রীসুলভ আদরযত্নই করল, আকন্ঠ গেলার পয়সাও দিল।একসাথে টলতেটলতে খিস্তিখেউর করতে করতে বাড়িও ফিরে গেল দুজনে।পরদিন সকালে রক্তমাখা দা- খানা হাতে যখন থানায় আত্মসমর্পন করলো পার্বতীয়া, তখন বোঝা গেল ভেতরে ভেতরে কতটা আগুন নিয়ে ঘুরছিল।তখনই জানা গেল, জগদীশ ওর প্রথম মরদ, পার্বতীয়াকে বাঁজা বলে মারধোর করে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল জগদীশের মা,জানত না বাচ্চার বাপ হবার ক্ষমতা ওর ছেলের ই নেই।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*