মা দশভূজা দক্ষিণেশ্বরের দিক থেকে এসে মঠের দিকে আসছেন

তরুণ গোস্বামী : ১৯০১ সালের মে কি জুন মাস স্বামী বিবেকানন্দ শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে প্রথম মঠে দুর্গাপুজো করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং রঘুনন্দনের ‘অষ্টবিংশতি তত্ত্ব’ বইখানি তাঁর জন্য আনতে অনুরোধ করেন। এরপর তিন-চার মাস কেটে গেছে। স্বামীজি দুর্গাপুজো করার ইচ্ছাও আর প্রকাশ করেননি। এদিকে দুর্গাপুজোর সময় এগিয়ে এসেছে। পিতৃপক্ষ শেষ হয়ে দেবীপক্ষের সূচনা হবে এমন একদিন স্বামীজির এক গুরুভাই তাঁকে একটি স্বপ্নের কথা বলেন। তিনি বলেন, তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, মা দশভূজা দক্ষিণেশ্বরের দিক থেকে এসে মঠের দিকে এগিয়ে আসছেন। স্বামীজি আনন্দিত হয়ে মঠে পুজো করার কথা সবাইকে বলেন।

যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। স্বামী বিবেকানন্দ স্বামী প্রেমানন্দ এবং ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলালকে নিয়ে বাগবাজারে এলেন মা সারদামণির অনুমতি নিতে এবং তাঁর নামেই এই পুজোর সংকল্প করা হবে তা জানাতে। মা অনুমতি দিলেন এবং ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল কুমোরটুলিতে ঠাকুর বায়না করতে গিয়ে দেখেন সব প্রতিমা বায়না হয়ে গেছে। অনেক ঘুরে একটি প্রতিমার সন্ধান পাওয়া গেল যেটিকে বায়নাকারীরা নিতে আসেনি বা নেবে কিনা তা জানাওনি। একচালা দেবীমূর্তিটিকে দেখেই ভক্তি হয়। টানা টানা চোখ। স্নিগ্ধ মুখখানি যেন সবাইকে অভয় দিচ্ছেন। কৃষ্ণলাল মূর্তিটি ক্রয় করেন এবং সেই সুসংবাদটি স্বামীজিকে দেন।

এদিকে মঠে হই হই ব্যাপার। স্বামী ব্রহ্মানন্দ পূজার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুজো করবেন কৃষ্ণলাল এবং তন্ত্রধারক ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তী, স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের পিতা। ষষ্ঠীর বোধনের দু-দিন আগে ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল, স্বামী নিত্যানন্দ এবং কয়েকজন প্রতিমাখানি কুমোরটুলি থেকে নিয়ে এলেন। মা সারদামণি মঠে আসছেন, তাই নীলাম্বরবাবুর বাড়িটি একমাসের জন্য ভাড়া নেওয়া হলো। স্বামীজি পুজোর আয়োজন দেখে খুব খুশি হলেন, মঠে যেন আনন্দের হাট বসে গেল। এই নিখাদ আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু যিনি, সেই মা সারদাও পুজোর আগের দিন কয়েকজন মহিলা ভক্তকে নিয়ে নীলাম্বরবাবুর বাড়িতে এসে উঠলেন।

মহাসপ্তমীর দিন মা সারদার অনুমতি নিয়ে ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল পুজোর আসনে বসলেন এবং তন্ত্রধারক তাঁর আসন গ্রহণ করলেন। শাস্ত্র মেনে চলল পুজোর কাজ। মা-র নির্দেশে পশুবলী হলো না। তার জায়গায় চিনির নৈবেদ্য ও মিষ্টি মা দুর্গার পাশে শোভা পেতে লাগল।

অষ্টমীর দিন ধূম জ্বর এল স্বামীজির। তিনি নিজের ঘর থেকে বেরোতেই পারলেন না। রসিকতা করে শিষ্যকে বললেন, দ্যাখ আমিও একটুতেই রেগে যাই, কাকে কি বলতে কি বলে ফেলব তাই মহামায়া আমাকে জ্বরে ফেলে দিলেন। স্বামীজি দোতলার বারান্দা থেকে দেখলেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ মঠ প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ডুবে যাচ্ছে অনন্ত আনন্দ সাগরে। ভারতীয় দর্শনে আছে মঠের মধ্যে আনন্দের হাট বসেছে। যে সেই হাটে আসছে সেই ডুবে যাচ্ছে আনন্দে। আর ফিরে যেতে পারছে না। কিন্তু কিছু মানুষ থাকেন যারা আনন্দের হাটে ডুবে গিয়েও আবার ফিরে আসেন মঠের বাইরে থাকা মানুষদের আনন্দের হাটের কথা শোনাতে। এমন একজন মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণ। আনন্দময় ঠাকুর। স্বামীজি অনুভব করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পুজোর সময় সুমনদেহে মঠে অবস্থান করলেন। আর মা সারদার উপস্থিতিতে মঠের পুজো নতুন মাত্রা পেল। সন্ধিপুজোর সময় স্বামীজি পুষ্পাঞ্জলী দিলেন। নবমীর দিন অনেকটা সুস্থ বোধ করায় নবমীর রাতে শ্রীরামকৃষ্ণ যে সব গান গাইতেন তাঁর সুমধুর কণ্ঠে তা পরিবেশন করলেন। যজ্ঞের মধ্যে দিয়ে পুজো সম্পন্ন হলো। দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জন হলো। স্বামীজি নিজের ঘর থেকে দেখলেন প্রতিমা নিরঞ্জনের প্রাক্কালে ভাবে বিভোর হয়ে নাচছেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ। মা সারদা ফিরে গেলেন বাগবাজারে। এভাবেই বেলুড় মঠের প্রথম দুর্গাপুজো সম্পন্ন হলো।

কিন্তু এই পুজোর গভীর ঐতিহাসিক ও সামাজিক তাৎপর্য আছে। স্বামীজির তাঁর জীবিতকালে এই একবারই মঠে দুর্গোৎসব দেখেন। তাঁর দেহত্যাগ হয় ১৯০২ সালের ৪ জুলাই, দুর্গাপুজোর বেশ কয়েকমাস আগে।

যেহেতু স্বামীজিরা সবাই সন্ন্যাসী তাই একজন নারীর নামে পুজোর সংকল্পন করা হয়েছিল। এটি নিঃসন্দেহে একটি বিরলতম ঘটনা। যদিও পুজোতে অংশগ্রহণের মেয়েদের কোনও নিষেধের কথা শাস্ত্রে নেই কিন্তু বহু যুগ ধরে পুজোর মূল অনুষ্ঠান থেকে মেয়েদের সরিয়ে রাখা হয়েছে। এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও একটি পুরুষের নামেই পুজোর সংকল্পন করা হয়। স্বামীজি শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনে বিশ্বাস করতেন, একটি পাখা দিয়ে কোনও পাখি উড়তে পারে না। সমাজেও যদি পুরুষ এবং নারী একই সাথে পা না ফেলে সেই সমাজের অগ্রগতি স্তব্ধ হয়ে যায়। স্বামীজি সেদিন মা সারদার নামে পুজোর সংকল্প করে ভারতবর্ষের মাটিতে নারী জাগরণ এবং নারীমুক্তি আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। মনে রাখতে হবে, পুরুষ সন্ন্যাসী দ্বারা চালিত একটি মঠ তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন মা সারদা। স্বামীজির ভাষায় সুপ্রিম কোর্ট। মা-র সিদ্ধান্তই ছিল মঠের শেষ সিদ্ধান্ত। মা সারদা এই পুজো তাঁর নামে সংকল্প করা হবে, এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ভারতীয় নারীকে এক অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই ঘটনা অবশ্যই অভিনব এবং অনন্য। স্বামীজির কালাপানি পার হয়ে পাশ্চাত্যে যাওয়াটাকে বঙ্গদেশের ব্রাহ্মণকুল মেনে নিতে পারেনি। একে নরেন্দ্রনাথ দত্ত কায়স্থ, তার নামের আগে ‘স্বামী’ ব্যবহার করছে এতে প্রবল আপত্তি ছিল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের। কারণ, তাঁরা মনে করতেন, কায়স্থ সন্তানের সন্ন্যাস গ্রহণে কোনও অধিকার নেই। মনে রাখা প্রয়োজন, স্বামীজির শিকাগো ধর্মমহাসভার সাফল্যের পরে তাঁকে অভিনন্দন জানানোর জন্য টাউন হলে যে সভা ডাকা হয়েছিল তাতে স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সভাপতির আসন গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। কারণ, স্বামীজি অব্রাহ্মণ ছিলেন। উত্তরপাড়ার রাজা প্যায়ারীমোহন মুখোপাধ্যায় রাজি হয়েছিলেন সভাপতি পদটি অলংকৃত করতে। কিন্তু তাঁর শর্ত ছিল তাঁর বক্তৃতায় তিনি স্বামী বিবেকানন্দ বলবেন না, বলবেন ভাই বিবেকানন্দ এবং সভাতে সেটিই করেছিলেন।

পণ্ডিতকুল বেজায় চটে গেলেন, যখন স্বামীজি কলকাতাতে একজোড়া সাহেব-মেমকে সাথে নিয়ে পাশ্চাত্য থেকে ১৮১৭ সালের গোড়ায় কলকাতায় ফিরলেন। এই দম্পতি হলেন শ্রী ও শ্রীমতি সেভিয়ার। স্বামীজি দাড়ি কামাতেন, গেরুয়া ধুতি-লুঙ্গির মত করে পরতেন, মাথায় পাগড়ি এবং মঠ প্রতিষ্ঠা করলেন। সেখানেও সাহেব-মেমদের নিত্য আনাগোনা, তাই ব্রাহ্মণসমাজ ধরে নিলেন এই ম্লেচ্ছ সাধুটি হিন্দু আচার-ব্যবহার কিছুই মানে না। বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোতে এসে তাঁদের সেই ভুল ভাঙল। এবং তাঁরা স্বীকার করলেন, স্বামীজি হিন্দু রীতিনীতি সবই জানেন। তাঁরাও পুজোতে যোগদান করে অনাবিল আনন্দ পেলেন এবং স্বামীজির প্রতি যে উষ্মা তাঁদের ছিল তা অনেকটাই চলে গিয়েছিল। বেলুড় মঠের প্রথম পুজোর সবচেয়ে বড়ো সামাজিক তাৎপর্য মঠের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল সাধারণ মানুষের জন্য। তাঁরা সবাই আমন্ত্রিত এবং মঠে পুজোর ভোগ তাঁরা গ্রহণ করেন। মনে রাখা প্রয়োজন, জমিদার বাড়ির পূজা ছিল কিছু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সকলের জমিদার বাড়িতে যাবার অধিকার ছিল না। যাদের অধিকার নেই তারা দূর থেকেই জমিদার বাড়ির আলোর রোশনাই দেখে এবং ভোগের গল্প লোকমুখে শুনত। ১৯২৬ সালে কলকাতা শহর সিমলা ব্যায়াম সমিতিতে প্রথম বারোয়ারি পুজো হয়েছিল। সেই পুজোতে সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছিলেন এবং প্রসাদ পেয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও কংগ্রেসের বহু নেতা প্রবল আপত্তি তোলে।

বেলুড় মঠের পুজো সিমলা ব্যায়াম সমিতির বারোয়ারি পুজোর আড়াই দশক আগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সর্বসাধারণের প্রবেশ ও প্রসাদ গ্রহণ ছিল এই পুজোর মূল উদ্দেশ্য। স্বামীজি স্বপ্ন দেখেছিলেন শ্রেণিহীন, শোষণহীন ভারতবর্ষের। ‘নতুন ভারত বেরুক চাষার কুটির থেকে, ভুনাওয়ালার উনোনের পাশ থেকে, ঝোড় জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে।’ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ভারতবর্ষ। বেলুড় মঠের পুজোয় দলে দলে সাধারণ নারী পুরুষ এসেছেন, প্রসাদ পেয়েছেন এবং আনন্দ সাগরে ডুবে গেছেন। নরনারায়ণের পুজো। মাকে যে শুদ্ধভাবে ভোগ রান্না দেওয়া হলো ঠিক তেমনিভাবে সন্ন্যাসীরা ভোগ পরিবেশন করলেন সাধারণ মানুষকে। প্রসাদ গ্রহণ করে তাঁরা তৃপ্ত। এই জ্যান্ত দুর্গাদের পুজো স্বামীজি চেয়েছেন এবং বেলুড় মঠের প্রথম পুজোর মধ্যে দিয়ে মানব পুজোর শুভ সূচনা করে গেলেন। এই ঘটনার গুরুত্ব এবং তাৎপর্য তাই ঐতিহাসিকভাবে এবং সামাজিকভাবে অপরিসীম।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*