জহুরি জওহর চেনেন

পিয়ালী
৭ জুন ২০২১। কলকাতায় তৃণমূল ভবনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাংবাদিক সম্মেলন। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দলের ভবিষ্যত কর্মসূচি নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন। বিকাল চারটে ছিল সাংবাদিক সম্মেলনের নির্ধারিত সময়। ৩টে ৪৭-এ তৃণমূল ভবনের মিডিয়া সেন্টারে ঢুকলেন। অপেক্ষা করলেন নির্ধারিত সময় অবধি। প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানালেন এই করোনা পরিস্থিতিতে জীবন বিপন্ন করে সাংবাদিক-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষজনকে অবদানকে। ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যের পরিবর্তনের সরকার আসে। সেই বছরই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগদান করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৮৭ সালে ৭ নভেম্বর জন্ম। সেদিক থেকে দেখলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রাতৃপুত্র অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতি অল্প বয়সেই রাজনীতিতে অভিষেক। ২০১৪ সাল তাঁর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওই বছরই দলের যুব সংগঠনের দায়িত্ব নেন তিনি। তার আগে অবশ্য যুবা-র দায়িত্বে তিনি ছিলেন। এর পাশাপাশি একসময়ের বামেদের গড় ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। লোকসভায় সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হওয়াই নন, ফ্লোরে তাঁর বক্তব্য দেখে অনেকেই বলেন, এই ছেলে অনেক দূর যাবে। এই প্রতিবেদকের মনে পড়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় একটি প্রশাসনিক বৈঠকে সাংসদ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠকের মধ্যমণি ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আরও অনেকের মতই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বক্তব্য পেশ করতে বলা হয়। অত্যন্ত সুচারু ভাষায় নিজের এলাকার মানুষের ছবি পিসি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানান তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, অভিষেক তুই তো ভালো বাংলা বলছিস। ইংরাজিমাধ্যম স্কুলে আগাগোড়াই পড়াশোনা করেছেন অভিষেক। পরে দিল্লিতে ম্যানেজমেন্টে ডিগ্রি লাভ করেন। হিন্দি, ইংরাজি দুটি ভাষাতেই তাঁর দক্ষতা বা মুন্সিয়ানা সহজাত। কিন্তু বাংলা ভাষা রপ্ত করে রাজ্যের আপামর জনগণের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার দক্ষতা তাঁর অতি বড় সমালোচকও মেনে নেন। এইরকমই এক সভার সাক্ষী এই প্রতিবেদক। সালটা ছিল ২০১৬। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিদ্যানগর। ষাটের দশকে এই বিদ্যানগর কলেজে অধ্যাপনা করতেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তখন পাকা রাস্তা ছিল না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য প্রণব মুখোপাধ্যায় অধ্যাপনা করতে আসতেন এই কলেজে। কলেজে এসে তাঁর সেই যৌবনে অধ্যাপনা করা বিদ্যানগর কলেজ প্রাঙ্গণে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন প্রণববাবু। সেখানেও উপস্থিত ছিলেন সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রাজ্ঞ প্রণববাবুর কাছে অভিষেক তখন নিতান্তই নবীশ। এই অনুষ্ঠানে প্রণববাবু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ভালো কাজ করেছেন, সে কথা বলেন তিনি। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। হঠাৎ প্রণব মুখোপাধ্যায় দু-পা এগিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাছে ডাকেন। তাদের মধ্যে কিছু কথোপকথনও হয়। অভিষেককে প্রায় জড়িয়ে তাঁর পিঠ চাপড়ে দেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। অনেকেই তখন ভেবেছিলেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রাতুপুত্র বলে এবং বয়স কম বলে তিনি অভিষেককে এতটা গুরুত্ব দিলেন। তারপর পাঁচ বছর কাটল। গঙ্গা-যমুনা দিয়ে জল অনেক বয়ে গেছে। প্রণববাবুও ইহকাল ত্যাগ করেছেন।
আজকের সাংবাদিক সম্মেলনে অভিষেকের ম্যাচিওরিটি দেখে একটা কথাই বলা যায়, জহুরি জওহর চেনেন। পুরো সাংবাদিক সম্মেলনে একটাও ফাউল করেননি তিনি। পরিষ্কার জানিয়েছেন, তিনি সেকেন্ড ম্যান নন, তিনি দলের কর্মী মাত্র। তাঁদের দলে প্রথম স্থান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাকি সবাই কর্মী। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ইতিমধ্যেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী, সুব্রত মুখার্জি, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত সিনিয়র নেতাদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে তাঁদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ নিয়েছেন অভিষেক। এর আগে তাঁকে দলের অভ্যন্তরে এবং সমালোচকরা অনেকেই বলতেন দুর্বিনীত। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর একের পর এক পদক্ষেপ সেই সমালোচনাকে ভুল প্রমাণিত করছে। এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে রাহুল গান্ধির টানা হয়। এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন রাহুল গান্ধির সফলতা নিয়ে। অত্যন্ত বুদ্ধি দিয়ে এই প্রশ্নের গুগলি সামলান অভিষেক। পরিবারতন্ত্র নিয়ে বিজেপিকেই তুলোধনা করেন এবং সমালোচনা তো দূরঅস্ত, রাহুল গান্ধিকে নিয়ে একটি কথাও বলেননি। দল এবং দলনেত্রী সায়নী ঘোষকে যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি করেছেন। অর্থাৎ তাঁরই জায়গায় এসেছেন সায়নী। সায়নী বলেন, আমার এগোনোর পথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শ খুবই জরুরি। অভিষেক বলেন, সায়নী পার্টিকে ফুল টাইম দেবে। ও হোলটাইমার হয়ে সারাদিনই অর্গানাইজেশনের কাজ করবে। প্রসঙ্গত, তৃণমূল কংগ্রেস দলে ২৩ বছরের ইতিহাসে মহিলা যুব সভাপতি কেউ হননি। সে ক্ষেত্রে সায়নী দৃষ্টান্ত। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী, সুব্রত মুখার্জি, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়— এঁরা প্রত্যেকেই বাংলার রাজনীতির উজ্জ্বল নাম শুধু নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও অভিজ্ঞ। তাঁদের প্রতি অভিষেকের এ হেন আচরণ সমালোচকদের মুখে কুলুপ আঁটতে বাধ্য করেছে।
২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ভালো ফল করায় এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ফলাফল যথেষ্ট ভালো না হওয়ায় অনেকেই আঙুল তুলেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে। অভিষেককে বেশি প্রাধান্য দিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, একথা দলের ভিতরে লোকেরা ফিসফিস করে বলেছেন, অন্য দলের লোকেরা সোচ্চারে বলেছেন। এক্ষেত্রেও আবারও বলা যায় জহুরি জওহর চেনে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলের যুব সভাপতি এবং পরবর্তীতে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক যাঁকে করলেন, তিনি সত্যিই তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে তা অর্জন করলেন। প্রশান্ত কিশোরকে দলে আনা এবং তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনার সম্মুখীন হওয়া অভিষেক দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছিলেন সবকিছু। নির্বাচনি প্রচারে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁকে তোলাবাজ ভাইপো বা ভাতিজা কল্যাণ ইত্যাদি নানা বিশেষণে বিদ্ধ করেছিলেন। অবশ্য তার পাল্টা জবাবও অভিষেকও চাঁচাছোলা ভাষায় দিয়েছিলেন। তবে একটা কথা এখানে বলা যায় যে, নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, জে পি নাড্ডা যেভাবে তাঁদের প্রচারে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করেছেন, তাতে এটাও বলা যায়, যে বিরোধীরা তাঁকে এতটা স্পেস যেহেতু দিয়েছেন, তারাও জহুরি চিনেছিলেন জওহর।
৩৩ বছরের অভিষেককে সম্প্রতি ‘নাবালক’ বলে সমালোচনা করেছেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দুকে কুৎসা, অপপ্রচার না করে সদর্থক সমালোচনার কথা বলেন তিনি। দলের প্রসার নিয়ে উল্লেখযোগ্য ভাবে বলেন, বাংলা ছাড়া অন্য কোনও রাজ্যে একটা-দুটো আসন পাওয়ার লক্ষ্যে এগোনো নয়। সেখানে সরকার গঠন করতে যাতে তৃণমূল কংগ্রেস পারে, সেই ব্যাপারে এগোবেন তাঁরা। উল্লেখযোগ্য হল এই যে, রাজ্যপাল প্রসঙ্গে একটিও কুকথা বলেননি সাংসদ তথা তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, রাজ্যপালের রাজ্যপাল সুলভ আচরণ করা ভালো। ঘরছাড়াদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারেও নাম, ঠিকানা দিলেই এ ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যবস্থা নিচ্ছেন, একথা বলেন তিনি। ২৯২টি আসনের মধ্যে ২১৩টি আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয় প্রমাণ করেছে, বাংলায় হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ হয় না। ইয়াস বিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শনের গিয়েছিলেন অভিষেক। নতুন পদে অভিষেক হওয়ার পর নিজেকে আরও বেশি সক্রিয় করে তুলছেন। এদিন রাজ্যে বাজ পড়ে ২০ জন নিহত হন। তিনি ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় তিনি যাবেন, একথা জানান সাংবাদিকদের। অবশ্য রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মিসভা করে তিনি মানুষের মন বোঝার চেষ্টা তিনি অনেক আগে থেকেই করতেন। বহরমপুরে এরকমই একটি কর্মিসভা করে ফেরার পথে মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েন তিনি। চোখ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একটু সুস্থ হয়েই তিনি জনতার মাঝে আসেন। অব্যাহত তাঁর চলার গতি।
এবারে রাজভবনে মুখ্যমন্ত্রীর শপথের দিন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। রাজ্যপালও তাঁকে ডেকে নিয়ে আলাদা করে কথা বলেন। এটাকে সৌজন্য বা শিষ্টাচার বলে মনে করা হলেও রাজনীতিতে দিনকে দিন নিজেকে ঘষেমেজে তৈরি করছেন অভিষেক। পরিশ্রম, মেধা এবং পিসি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথ অনুসরণ করে চলেছেন তিনি। একটা কথা বলা যায় যে, প্রণববাবু থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চ্যাটার্জি থেকে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ভুল হয়নি তাঁদের মানুষ চিনতে।এবার এই হীরকদ্যুতি দেশের রাজনীতির অঙ্গনে কতটা আলো ছড়াতে পারে, সেটা দেখার অপেক্ষায় সবাই।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*