জিরো পয়েন্ট

রাজকুমার ঘোষঃ

পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার মজাই আলাদা রকমের, সেটা যদি আবার সিকিমের মত পাহাড়ি রাজ্য হয় । ভাবা যায় গোটা রাজ্যটাই পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত, যার রাজধানী গ্যাংটক হল তার মধ্যমণী । ৫ বছর আগে আমরা দার্জিলিং-এ যাব বলে বেড়িয়েছিলাম, কিন্তু রাজনেতিক অস্থিরতার দরূণ আমরা সিকিমে চলে এসেছিলাম । তখন আমরা ছাঙ্গু, বাবাধাম, ইয়ুমথাংগ পর্যন্ত্যই আটকে গিয়েছিলাম, কিন্তু লোক মুখে শোনা জিরো পয়েন্টকে না দেখেই ফিরে আসতে হয়েছিলো । কাছে এসেও দেখতে না পেয়ে  ভীষণ আক্ষেপ হয়েছিলো । মনের সেই ইচ্ছাটা ভাগ্যিস ধরে রেখেছিলাম । তাই এবারের পূজোর পর টার্গেট করেই রেখেছিলাম যে আবার আমরা গ্যাংটক যাব, মূল উদ্দেশ্য অবশ্যই জিরো পয়েন্ট ।   

          ইচ্ছা অনুযায়ী লক্ষী পুজোর ঠিক পরের দিনই আমরা দল বেধেঁ গ্যাংটক থুরি জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম । প্রায় ৮ জন নিয়ে  আমাদের দল বেশ ভারী ছিলো । স্বাভাবিক ভাবেই আমরা সবাই খোশমেজাজে । আমার হিরো মানে আমার ছেলে ঋষভ তো বেজায় খুশি । তার কাছে এই ঘুরতে যাওয়া এক বিরাট অনুভব, সে আমার কাছে সিকিম তথা গ্যাংটক এমনকি জিরো পয়েন্ট নিয়েও জেনে নিয়েছে ।

আমরা সবাই গ্যাংটক পৌছে গেলাম, সেদিনের মত বিশ্রাম নিয়ে তার পরের দিন থেকেই আমাদের চোখ থাকার স্বার্থকতাটা বুঝতে পারলাম । পরের দিন ছাঙ্গু ও বাবাধাম, তার পরের দিন পশ্চিম সিকিমের সান্ড্রাপ্সি, সাই বাবার মন্দির ও চারধাম দেখে আমরা সবাই অভিভূত । আমাদের খুব ইচ্ছা ছিলো যে ছাঙ্গু ও বাবাধামের বরফ পড়া দেখবো, কিন্তু বেশ হতাশ হয়েছিলাম । কিছুই দেখতে পেলাম না । যেদিন গিয়েছিলাম ঠিক তার পরের দিনই নাকি বরফ পড়েছে । হতাশ যেন আরো বেড়ে গেলো । বৃষ্টি পড়ায় নাকি ওখানে বরফ পড়েছে । তা আমরা গ্যাংটকের যে হোটেলে ছিলাম, সেখানকার ম্যানেজার বললো জিরো পয়েন্টে বরফ নাকি পাবোই, শুনে বেশ আনন্দ পেলাম । সেইভাবে ম্যানেজারই ব্যবস্থা করে দিলো । মাথা পিছু ১৫০০ টাকা প্যাকেজে আমাদের উত্তর সিকিমে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো । সে দায়িত্ব নিয়ে আমাদের তার পরের দিন বেলা ১১টায় গাড়িতে তুলে দিলো । গ্যাংটক থেকে আমরা উত্তর সিকিমের দিকে যাওয়া শুরু করলাম । এরপর আমরা যত এগোচ্ছি উত্তর সিকিমের দিকে ততই মনে শিহরণ জাগছিল, বিশেষ করে ঋষভের । হয়তো এর আগে আমরা এই রাস্তা দিয়ে ইয়ুংথাংগ গিয়েছি, কিন্তু হাওড়ার দূষণ যুক্ত দৃষ্টি বারে বারে এই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হবে এটাই তো স্বাভাবিক । দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম মঙ্গনে । তার আগে অবশ্য আমরা ড্রাইভারের ঠিক করা একটি হোটেলে লাঞ্চটা করে ফেলেছিলাম । এরপর আমরা যাবার পথে ‘সেভেন সিস্টার’ জলপ্রপাত দেখলাম । ভয়ংকর সুন্দর এই জলপ্রপাতটি দেখে সকলে মোহিত হয়ে গেলাম । এই ফলসের কাছে গিয়ে আমরা যে যার মতো পোস দিয়ে ছবি তুলে নিলাম, আমিও এই প্রাকৃতিক দৃশ্যকে উপভোগ করে ক্যামেরা বন্দী করে নিলাম ।

         

বিকাল ঘনিয়ে সন্ধ্যে হয়ে এলো অথচ আমাদের গন্তব্য লাচুং তখনও অনেক দূরে । গতবারে যখন এসেছিলাম আমরা প্রায় সন্ধ্যের মুখে লাচুং এ পৌছে গিয়েছিলাম । কিন্তু এবার রাস্তা ভীষন খারাপ থাকায় এত সময় লাগলো । ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে জানালো লাচুং পৌছতে রাত ৮টা বেজে যাবে । উত্তর সিকিমে চুংথাং নামে একটি টাউন ছিলো । গ্যাংটক থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে উত্তর সিকিমের একটি জনপ্রিয় টাউন, যেখানে ইন্ডিয়াম আর্মির বেস ক্যাম্প আছে, আর বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আছে । সন্ধ্যে হওয়ার দরুন আমরা এই চুংথাং টাউন টিকে সেইভাবে দেখতে পেলাম না । উত্তর সিকিমের আরেকটি জনপ্রিয় টাউন মঙ্গনও খুব সুন্দর । এই পাহাড়ি টাউনটির চারিদিকে বিশাল জনবসতি ও দোকানপাটে ঘেরা  । গতবারে এসে ছোট অথচ জনপ্রিয় এই টাউনটি দেখে দারুন  আনন্দ পেয়েছিলাম । ভাবতে পারেনি যে এই দূর্গম পাহাড়ের মাঝে এত সুন্দর একটি টাউন থাকতে পারে । কিন্তু এবারে গিয়ে এই মঙ্গন-এর রুপ দেখে একেবারে মন খারাপ হয়ে গেল ।  ৮ই সেপ্টেম্ব র, ২০১১ এ এক বিদ্ধস্ত ভুমিকম্পে মঙ্গন পুরোপুরি ভাবে এলোমেলো । এখানে রাস্তাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে । সিকিম সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে উত্তর সিকিমকে আরো সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তোলার । প্রায় ৬.৯ ম্যাগ্নিচুডে জোরালো ভুমিকম্পে মঙ্গন সহ উত্তর সিকিমের অন্যান্য জায়গায় যে প্রভাব পড়েছে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । আমরা প্রায় ৭ টার সময় চুংথাং এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ই টের পাচ্ছিলাম যে এই পথ কত দূর্গম ! যাই হোক ঠিক রাত ৮ টার খানিক আগে ড্রাইভার লাচুংয়ে  আমাদের একটি হোটেলের সামনে গাড়ি নিয়ে চলে এলো । বুঝে গেলাম আজকের রাতে আমাদের এইখানেই থাকতে হবে । রাত ১০ টা নাগাদ আমাদের ডিম-ভাত-সব্জি দিয়ে ডিনার খাওয়াতে বুঝে গেলাম গ্যাংটকের হোটেলের ম্যানেজার আমাদের কতখানি চুনা দিয়েছে । হোটেলের অবস্থা মোটামুটি মন্দের ভালো । ড্রাইভার সকলকে বলে গেলো ভোর ৬ টার সময় উঠতে হবে, সে আমাদের ইয়ুংথাম এ নিয়ে যাবে, তারপর মর্জি হলে জিরো পয়েন্ট । আসলে গ্যাংটকের ঐ হতচ্ছারা ম্যানেজারের প্যাকেজ এ জিরো পয়েন্ট ছিলো না ।

                ভোর ৬ টার সময় আমরা ঘুম থেকে উঠে যে যার মত করে প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম । ঋষভও দেখলাম বেশ উৎসাহ নিয়ে তৈরি হয়ে গেছিলো । প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা ইয়ুংথাম চলে এলাম ।  সেখানে গতবারে এসে আমরা দারুন মজা করেছিলাম, তাই এবারে এসে অতটা আগ্রহ দেখালাম না । আমাদের চোখ যে জিরো পয়েন্ট । ড্রাইভারকে বললাম আমরা যত তাড়াতাড়ি পারি জিরো পয়েন্ট এ যেতে চাই । ওর সাথে ২০০০ টাকার রফা করে আমরা এগিয়ে চললাম জিরো পয়েন্টের দিকে । আমাদের চোখ সার্থক হবেই এই মনোভাবে একরাশ আনন্দ ও প্রত্যাশা নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম কাঙ্খিত জিরো পয়েন্টের দিকে । যেতে যেতে কত সুন্দর দৃশ্য আমাদের নজরে এলো যে অভিভূত শব্দও বুঝি তাতে কম হয় । গাড়ি থেকেই আমি অনেক দৃশ্য আমার মোবাইলের ক্যামেরায় নিয়ে নিলাম । আরো ৪০ মিনিট পর আমরা পৌছে গেলাম জিরো পয়েন্ট এ । গাড়ি থেকে নেমেই আমি প্রনাম জানালাম এই অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য কে । যে দিকে তাকাই শুধু সাদা চাদরে মোড়া বরফের সমাহার । ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করবো, কোথা থেকে শুরু করবো এই অনন্য সুন্দর শোভাকে নিজের মত করে উপভোগ করার, বেশ দ্বন্ধে পড়ে গেলাম । যেদিকে চাই, সেদিক টাকেই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে । অনেক ছবি তুললাম মনের মত করে , তবুও যেন কম হয়ে যাচ্ছে । প্রায় ১০০ র বেশি ছবি তুললাম, যেটাও খুবই নগণ্য । আমার ছেলে ঋষভ বরফ নিয়ে খেলা করতে লাগলো, ওর মাও অর সাথে যোগ দিলো । ওরাও ওদের মত করে এই সৌন্দর্য্যকে উপভোগ করতে লাগল । তার ওপর সূর্যমামা আজ বড়ই প্রসন্ন, তার ছটা উঁচু হয়ে থাকা বরফে আবৃত শৃঙ্গ গুলোকে আর আলোকিত করে তুলেছিলো । আমিও সেই মনোরম শোভাকে ক্যামেরা বন্দী করতে ভুল করলাম না

আমরা সবাই বিভিন্ন রকম পোস দিয়ে ছবি তুলতে লাগলাম । আমি নিজেকে হিরো ভেবে পোস দিলাম আর আমার স্ত্রীকে বললাম ফটো তুলতে । তার ওপর বেশ কনকনে ঠান্ডা, আমি শুধু সোয়েটার পড়ে শাহরুখ খান স্টাইলে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম । প্রায় ২ ঘন্টা আমরা সবাই বেশ মজা করলাম । ঐ ২ ঘণ্টা কাটিয়ে আমাদের মনে হলো যে সমস্ত পয়সা উসুল, আমাদের এখানে আসা সার্থক । গ্যাংটকের হোটেলের ঐ বদ ম্যানেজারকে আর গালাগাল দিতে ইচ্ছা করলো না । কারণ আমাদের চোখে শুধু জিরো পয়েন্টের শোভাই বিরাজ করছে । ফেরার পথে আরো অনেক ছবি তুলে আমরা লাচুং এ ফিরে এলাম । আবার সেই ডিম-ভাত-সব্জি দিয়ে লাঞ্চ করে গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে ফিরে যাওয়ার পথ ধরলাম । ঐ পথ ধরে যখন ফিরছিলাম, ভয়ানক দূর্গম রাস্তা দেখে আমরা হতবাক । অথচ ড্রাইভার গতকাল রাতেই ঐ রাস্তা দিয়েই নিয়ে এসেছে । মনে মনে ড্রাইভার কে বাহবা দিলাম । চুংথাং টাউন দিয়ে যাবার সময় একটা মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের সকলকে বেশ ব্যাথিত করে দিল । জানতে পারলাম একটা মিলিটারি গাড়ি নাকি খাদে পড়ে গেছে । ঐ গাড়িতে ইন্ডিয়ান আর্মির প্রায় ১৬ জন জওয়ান ছিলো । ড্রাইভারই আশেপাশের লোকজনের কাছ থেকে খবর নিয়ে আমাদের কে  জানালো । মঙ্গন হয়ে ফেরার সময় আবার  ‘সেভেন সিস্টার’ ফলস দেখে ফেললাম । বিকাল হয়ে সন্ধ্যে চলে এলো । আমাদের গাড়ি গ্যাংটকের দিকে ছুটে চলেছে । গাড়িতে আমাদের সবাই ঘুমে কাতর । আমার চোখ দুটো একটু বুজতে চাইলো, কিন্তু জিরো পয়েন্টের সমস্ত সোন্দর্য্য সেটা হতে দিলো না । ক্লান্ত চোখ নিয়ে আমি আমার মোবাইলের নোটপ্যাডে একটু কবি হওয়ার চেষ্টা করলাম ………

বরফের চাদর

কি অপূর্ব শোভা, তার কি মহিমা !!

সার্থক, আজ আমি  করি তার বন্দনা … 

বরফের চাদরে মোড়া, হে অপরূপা

জিরো পয়েন্ট, সৃষ্টির  অনন্য এক শিরোপা !

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*