গৌতম চট্টোপাধ্যায়ঃ
পশ্চিমের বটগাছের আড়ালে ছায়াটা ক্রমশ বড় হচ্ছে;
কোন এক অজানা মুখবন্ধ লেখার মাঝেই,
আমার দৃষ্টি যাচ্ছে সেইদিকেই বারবার।
যেন সে আমায় ডাকছে, ঘিরে ধরবে বলে,
ডাকছে, একবার পরখ করবে বলে,
ডাকছে, হয়তো জড়িয়ে ধরে ভরিয়ে দেবে আদরে।
চশমাটা ভেঙেছে বহুদিন হলো,
দূরের ধূসর নিস্পলক সমুদ্রতটে,
কান পাতলে শোনা যায় ঢেউ ভাঙার শব্দ।
তিনি আসছেন, ধীর পায়ে,
রোদ মেঘের খেলা উপেক্ষা করেই।
বয়স আন্দাজ প্রায় ষাট,
এক মাথা রুক্ষ চুল, গাল ভর্তি দাড়ি,
পরনে শুধু নোংরা ছেড়া প্যান্ট, হাতে লাঠি।
তিনি এসে দাঁড়ালেন ঠিক আমাদের পাশের বাড়িটায়,
বেল টিপলেন, একবার-দুবার-তিনবার,
তারপর সজোরে কড়া নেড়ে চিৎকার করলেন, “মৃত্যুঞ্জয়..মৃত্যুঞ্জয়…”
-“নৃপেন জ্যেঠু না!!”
জেলখানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি নেমে এলাম রাস্তায়;
বাড়িটার জানলা দরজা সব বন্ধ,
যা গরমের দুপুরে এক স্বাভাবিক দৃশ্য।
সেই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে তিনি আবার চিৎকার করলেন,
-“মৃত্যুঞ্জয়…আমি এসেছি মৃত্যুঞ্জয়,
একবার, শুধু একবার দরজাটা খোল,
এখনও যে তোদের মানুষ করতে হবে।”
আমি হতবম্ব, চুপচাপ চেয়ে দেখছি,
উনার কিন্তু বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই এইদিকে,
তিনি নিজের মনে বলে চললেন,
-“এত সহজেই ব্রাত্য করলি বাবা!!
আমি যেতে চাইনা মৃত্যুঞ্জয়,
আমি লড়তে চাই, আমি বাঁচতে চাই।”
তারপর একটা শেষ হাঁক পাড়লেন, “মৃত্যুঞ্জয়…”
কেউ শুনলো না, কেউ দিল না সাড়া,
দরজা জানালা সেই আগের মতই বন্ধ,
নিস্তব্ধতা আবার গ্রাস করলো চারিদিকে।
এবার আস্তে আস্তে তিনি আমার দিকে ঘুরে তাকালেন,
চোখ ঘোলাটে, কষ্টের ছাপ স্পষ্ট,
কিন্তু এক ফোটাও জল নেই তাতে।
উলঙ্গ বক্ষস্থল জুড়ে হাজারো স্টিচের দাগ,
কোনটা শুকিয়েছে আবার কোনটা দগদগে ঘায়ে পরিণত।
রক্তশূন্য শরীরটা আমাকে বলে উঠলো, “আমি হেরে গেলাম।”
ক্ষণিক চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“একটু জল খেয়ে গেলে হতো না!!”
তিনি সেই মায়াজড়িত চোখে চেয়ে মুচকি হাসলেন,
তারপর পিছন ফিরে আবার মিলিয়ে গেলেন…
ঠিক ওই পশ্চিমের বটগাছের আড়ালে।
মানুষের সব অহংকার পুড়ে যায়,
মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিটের চুল্লিতে।।
অসাধারণ প্রকাশ , কবিকে স্যালুট জানাই