শুভ শুক্রবারে মুকুলের পুরোনো ঘরে ফেরা

পিয়ালি


অনেক অপপ্রচারের বলি আমরা; তবুও জনতার দরবারে আমাদের আবেদন এইটুকুই, বিশ্বাস রাখুন, ভরসা রাখুন আমাদের উপর। মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা— এরকম কোনও কাজ আমরা করব না। আস্তে আস্তে নিজের পায়েই দাঁড়াবে তৃণমূল, কারও উপর নির্ভরশীল হয়ে নয়। এই এক বছরে সবার কাছ থেকে যে সহযোগিতা পেয়েছি, সেটাই আমাদের ভবিষ্যত।

দল প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায় তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘তৃণমূল’ নামক বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন এই কথা। তিনি আরও লিখেছেন, অনেক চক্রান্ত চলছে তৃণমূল কংগ্রেসকে শেষ করার। আমার ছোট্ট আবেদন, ব্যক্তিগতভাবে আমার উপর যদি কোনও রাগ থাকে তাহলে আমার চিরতরে বিদায় কামনা করুন। কিন্তু অনাগত ভবিষ্যতের নতুন প্রজন্মকে শেষ করে দেবেন না। সেই নতুন প্রজন্মের দাবি, ওদের কথাই তৃণমূল কংগ্রেসের কথা। ‘তৃণমূল কংগ্রেস’— এই এক বছরের শিশুকে বাঁচিয়ে রাখুন শুধু বাংলার স্বার্থে। এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৈরির ত্যাগ, তিতিক্ষা, পরিশ্রম, কৌশল, দক্ষতার পরিচয় মেলে।

আজকে এই বইয়ের এই লাইনগুলি প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে, হাত চিহ্ন থেকে ঘাসফুল বা জোড়াফুল চিহ্নে আসার যে প্রক্রিয়া তাতে মুকুল রায়ের অবদানের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, ১ জানুয়ারি ১৯৯৮ ছিল আমাদের কাছে এক পবিত্র দিন। যেদিনটা ছিল রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কল্পতরু উৎসবের দিন এবং রমজান মাসের প্রথম দিন। সুতরাং ইতিহাস তৈরি হল সংহতির মেলবন্ধনে— ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’।

এই লাইনগুলির প্রাসঙ্গিকতা এটাই যে, আজ শুক্রবার। এবং তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার দিন থেকে বা তারও আগে থেকে তাঁর অনুগত সঙ্গী মুকুল রায়-এর বিজেপি ছেড়ে ঘর ওয়াপসি হল আজ। শুধু রাজ্য রাজনীতি নয়, জাতীয় রাজনীতিতে আজকের দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে শুক্রবার দিনটি সবসময়ই জন্যই পয়া। অনেকেই জানেন, তিনি শুক্রবারে সন্তোষী মাতার পুজো করেন। আবার শুক্রবার হল জুম্মাবার, খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রেও এটি পুণ্য দিন। এহেন শুভ দিনে পুরোনো সঙ্গীকে তৃণমূল পরিবারে ফিরে পাওয়া অবশ্যই রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

মুকুল রায়কে যথেষ্ট সম্মান দিয়েই তৃণমূল কংগ্রেসে ফেরানো হল। তৃণমূল ভবনে নির্ধারিত সময়ে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চ্যাটার্জি, মুকুল রায়, সুব্রত মুখার্জি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঢুকছেন, তখন সাধারণ চেয়ারের পাশাপাশি একটি কাঠের চেয়ার রাখা হয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বভাবচিতভাবে ওই বড়ো চেয়ারটিকে সরিয়ে দেন। বুঝিয়ে দেন, দলে সবাই সমান। আর একটি জিনিসও আমাদের চোখ এড়ালো না, তা হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে বসলেন মুকুল রায় এবং স্টেজে ওঠার আগে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে আগে যেতে বললেন, পরে উঠলেন অভিষেক।

এরপর মুকুল রায় ও তাঁর ছেলে শুভ্রাংশু রায়-কে উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন অভিষেক। সাংবাদিকদের চোখা প্রশ্ন, অভিষেকের সঙ্গে আপনার যে সম্পর্ক খারাপ ছিল, এখন কি মিটে গেছে? মুকুলবাবুর উত্তর, অভিষেকের সঙ্গে আগেও কোন মতবিরোধ ছিল না, এখনও কোন মতবিরোধ নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন বলেন, ওল্ড ইজ অলওয়েজ গোল্ড। মুকুল রায় বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি ছিলেন। তৃণমূলে ফিরে আসার পর তাঁকে যোগ্য স্থান দেওয়া হবে। প্রসঙ্গত, তৃণমূল ভবনের যে অংশটি এখন অত্যাধুনিক মিডিয়া সেন্টার, সেই ঘরের এক অংশে তৃণমূলে থাকাকালীন বসতেন মুকুল রায়।

মুকুলবাবু বললেন, পুরোনো ছেলেদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ভালো লাগছে। বিজেপির আঙিনা থেকে আমি নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। তিনি বলেন, বাংলা তথা ভারতবর্ষে আমাদের সকলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর হাত ধরে বাংলা আবার এক নম্বর স্থান পাবে।

তাঁর বিজেপি ছেড়ে আসার কারণ, বিস্তারিত ভাবে পরে জানাবেন, বলেন মুকুল। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এত নির্দয় বিজেপি দল যে সেখান থেকে এসে মুকুল যেন শান্তি পেল। ওরা মানুষকে ভালোভাবে থাকতে দেয় না। আমাদের দল শক্তিশালী দল। ইলেকশনের সময় আমাদের দলবিরোধী একটা কথাও মুকুল বলেননি। যারা গদ্দারি করে নিম্নরুচির পরিচয় দিয়েছে, তাদের নেব না। যারা ভদ্র, সভ্য, তারা ফিরলে সেকথা ভাবা হবে। শুভেন্দু অধিকারীর প্রতি তিনি যে অত্যন্ত বিরক্ত তা এদিনের সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্ট। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলেও শুভেন্দু প্রসঙ্গ উঠতেই ধন্যবাদ জানিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে দেন মমতা।

এর আগে মুকুল রায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, কেউ বিজেপিতে আর থাকবে না। প্রসঙ্গত, মুকুল রায় সেই ব্যক্তি যিনি দিল্লিতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতীক আনার সময় সুকৌশলে কার্যসিদ্ধি করেছিলেন। অবশ্য এই প্রক্রিয়া যার মস্তিষ্কপ্রসূত তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা ১৯৯৭ সালের শেষ দিক। দিল্লিতে নতুন দল তৈরির প্রক্রিয়া তখন চূড়ান্ত। কিন্তু নিজে নির্বাচন কমিশনে গেলে তা খবর হয়ে যাবে, তাই দিল্লিতে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহকর্মী রতন মুখার্জি ও মুকুল রায় সিল তৈরি করতে গিয়েছিলেন।

এই ব্যাপারেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর লেখায় বলেছেন, ‘মুকুল আর রতনদা দিল্লিতে গোল মার্কেটের কাছে সিল তৈরি করতে গিয়েছিল। দোকানদার প্রথমে বলেছিলেন, আভি বহুত অর্ডার হ্যায়। আপ দো দিন বাদ মে আইয়ে। আপ অর্ডার দে কে যাইয়ে। মুকুলদা তখন তাঁকে বলে, ভাইসাব হামারে হাত মে দো ঘণ্টা বক্ত হ্যায়। ইয়ে মমতাজি কা নয়া পার্টিকে লিয়ে। আভি চাইয়ে। দোকানদার তখন অবাক হয়ে গিয়ে বলেছিলেন, আপ পহেলে কিউ নাহি বাতায়া, ইয়া মমতাজিকা নয়া পার্টিকে লিয়ে হ্যায়। হাম আভি করতা। আপ এক ঘণ্টা বাদ মে আইয়ে।

এবার রতনদা, মুকুল চলে গেল সুপ্রিম কোর্টে এফিডেভিট করাতে। সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে রতনদার আবার ওখানে কাজ করার গতিবিধি জানা থাকাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে এভিডেফিট রেডি করে সিল নেওয়ার জন্য গোলমার্কেটে সেই দোকানদারের কাছে গেল। দোকানদার সিল রেডি করে রেখেছিলেন। মুকুল বলেছিল, ভাইসাব বহুত সুকরিয়া। কিতনা রুপিয়া লাগেগা? ছোট্ট দোকানদারটির চোখ ছল ছল করে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, হাম পয়সা নাহি লেঙ্গে, মমতাজিকা পার্টি জিতনে সে আপ হামকো জরুর মিঠাই খিলাইয়ে। রতনদা তাঁকে অনুরোধ করেছিল, ভাইসাব এই বাত আপ কিসিকো মত বাতায়ে। দোকানদার বলেছিলেন, হাম জরুর এক গরিব আদমি হ্যায়। লেকিন মমতাজিকে হামলোক বহুত ইজ্জত করতা হ্যায়। ম্যায় ইসকে বারেমে কিসিকো কুছ নেহি বাতায়েঙ্গে।’

এইরকম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই ‘উপলব্ধি’, ‘জনতার দরবার’, ‘মা’, ‘মানবিক’, ‘অবিশ্বাস্য’, ‘অনুভূতি’ ইত্যাদি নানা বইয়ে বিভিন্ন ছত্রে ছত্রে সহকর্মী হিসেবে মুকুল রায়ের পাশে থাকা এবং তার সাংগঠনিক ক্ষমতার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তাই ২০১৭ সালে মুকুল যখন নতুন দলে যোগদান করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তো বটেই, মানসিক যন্ত্রণাও পেয়েছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেস তো আর শিশু নেই। ২৩ বছরে উপনীত হয়েছে দল। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, ওঠা-পড়ার মধ্য দিয়ে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিনও তাঁর সঙ্গী ছিলেন মুকুল রায়। তারপর ৩ বছর ৮ মাস ভারতীয় জনতা পার্টিতে মুকুল রায় নেতা হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২১-এ কঠিন নির্বাচনে ল্যান্ড স্লাইড ভিকট্রি পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। ২৯২টি আসনের মধ্যে ২১৩টি আসন পেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমাণ করেন ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’। এই বিপুল জয়ের পর অনেক তৃণমূলের দলছুটই আবার তৃণমূলে ফিরতে চান।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন বলেন, চরমপন্থী, নরমপন্থী দুটো ভাগে ভাগ করেছি আমি। স্বাভাবিকভাবেই যাঁরা তাঁকে আক্রমণ করেননি বা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাদেরই ঘর ওয়াপসি সম্ভব। যাইহোক শুক্রবার ১১ জুন শুভদিনে মুকুল রায়ের মত সংগঠন বোঝা মানুষ আবার পুরোনো ঘরে ফিরে আসায় তৃণমূল শিবিরে খুশির হাওয়া।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*