ক্রিসমাসঃ ভিন্ন দেশ ভিন্ন রং

তপন মল্লিক চৌধুরীঃ

নাইজেরিয়ায় বিশেষত শহরে যারা থাকেন তারা বড়দিনে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যান। ফলে ক্রিসমাসের সময় নাইজেরিয়ান শহরগুলি একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। তখন যত ভিড় সবই গ্রামাঞ্চল আর শহরতলির বাজারগুলিতে । কিন্তু তার থেকেও বলার মতো বিষয় হল বড়দিনে নায়জিরিয়ায় কেক নিয়ে তেমন কোনও উদ্দিপনা চোখে পড়ে না, কেক তৈরির চেয়ে নানা ধরনের মাংসের সুস্বাদু পদ রান্না হয় অনেক বেশি । রান্নাকরা নানান মাংসের ওইসব পদের নামগুলিও খুব গালভরা—জুলোফ রাইস, টুয়ো, ফুফু ঈত্যাদি, সঙ্গে থাকে নানান পানীও ।

ইতালিতে বড়দিন উদযাপন উৎসব শুরু হয়ে যায় ৮ ডিসেম্বর থেকেই । ওইদিন থেকেই সবাই ক্রিসমাস ট্রি তৈরিতে হাত লাগায় । পাশাপাশি যীশুর জন্মের সময়কার ছবি ফুটিয়ে তুলতে মা মেরি, জোসেফ, একটি গাধা, একটি হাঁস,শিশু যীশুও তৈরি করা হয় । প্রায় এক মাসের উৎসব শেষ হয় ৬ জানুয়ারি । সেদিন সবাই ক্রিসমাস ট্রি তুলে ফেলে । এরমধ্যে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের পাশাপাশি ইতালিতে ২৬ ডিসেম্বর সেইন্ট স্টিফেন’স ডে পালন করা হয় । এছাড়াও ইতালির দক্ষিণাংশে বিশেষত সিসিলিতে আরেকটি দিন পালন করা হয়, ১৩ ডিসেম্বর বছরের সবচেয়ে ছোট দিনটি সেন্ট লুসিস ডে হিসাবে পালিত হয় । এই দিন ইতালিতে গমজাত বা আটার তৈরি কোনও খাবার খাওয়া হয়না ।

অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিসমাস যখন আসে তখন গ্রিস্মকাল কিন্তু তাতেও জাঁকজমকে কিছু ঘাটতি পরেনা । ওরা ইউরোপ আমেরিকানদের মতো করেই বড়দিনের উৎসব উদযাপন করে । আদিবাসীদের নিজস্ব ধর্ম থাকলেও তারা বড়দিনের উৎসবে অংশগ্রহণ করে । অস্ট্রেলিয়ায় বড়দিন উপলক্ষে দু’টি বড় খেলা অনুষ্ঠিত হয়, এটা ওদের ঐতিহ্য হয়ে দাড়িয়েছে– বক্সিং ডে টেস্ট আর ইয়ট রেস, সিডনি থেকে হোবারট পর্যন্ত হয় ওই প্রতিযোগিতা । ক্রিসমাসের আগমণী বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দিতে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড শহরে আয়জিত হয় এক বিশাল শোভাযাত্রা, তাতে জমায়েত হয় প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের । অন্যদিকে মেলবোর্ন শহরে অনুষ্ঠিত হয় ক্যারোলস বাই ক্যান্ডেল লাইটস নামে এক মিউজিক্যাল শো । বড়দিনের রাতে ‘সিডনি মেয়র মিউজিক বল’ নামে এই কনসার্টটি এখন এতই জনপ্রিয় যে টিভিতে ওই অনুষ্ঠান না দেখলে যেন অস্ট্রেলিয়াবাসীর ক্রিসমাস পালনই হয় না ।

ব্রাজিলেও ক্রিসমাসের সময় ঠান্ডা একেবারেই থাকে না কারণ তখন গ্রীষ্মকাল । কিন্তু বড়দিন বলে কথা সব জায়গাতেই ইউরোপ আমেরিকার মতো সাজসাজ রব পড়ে যায় । বিশেষ করে সাও পাওলো, রিও ডি জেনিরোর মতো বড় শহরগুলিতে সাজের বাহার দেখার মতোই । ঠাণ্ডা কিম্বা বরফ নেই বলে এখানে ক্রিসমাস-ট্রিগুলিতে তুলো ছড়িয়ে রাখা হয় । সবথেকে মজা হয় কিউরিতিবা শহরে । এখানে ঘর-বাড়ি সাজানো ঘিরে রিতিমতো প্রতিযোগিতা হয় । কার বাড়ি কত সুন্দর হল সেটা ঠিক করার জন্য বিচারকমন্ডলী ঘুরে ঘুরে দেখেন । প্রসঙ্গত, ব্রাজিলে সান্টা ক্লজকে ডাকা হয় পাপাই নোয়েল বলে । খাবারের তালিকায় থাকে বিশেষ একটি পদ—চকোলেট এবং কনডেন্স মিল্ক দিয়ে তৈরি ব্রিগেডেইরো । ২৪ ডিসেম্বর রাত বারোটা বাজলেই চার্চগুলিতে শুরু হয়ে যায় মিসা দ্য গ্যালো উদযাপন ।

মেক্সিকোতে ক্রিসমাসের আরও একটা নাম আছে—লাস পোসেদাস । এখানকার বড়দিন উৎসব অন্য যে কোনও জায়গার থেকে একেবারেই আলাদা । কেবলমাত্র তাই নয় ক্রিসমাস পালনের যে ধরনধারণ তা সংখ্যার দিক দিয়েও অনেক বেশি, প্রায় তিরিশ রকম । ক্রিসমাস এগিয়ে আসা মাত্র মেক্সিকানরা দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন, এটা চলে প্রায় ন’দিন ধরে, ঘটনা হল যীশু জন্মানোর পর মা মেরি একটু আশ্রয়ের জন্য দিনের পর দিন লোকের দরজায় দরজায় ঘুরে বেরিয়েছিলেন, সেই করুন ঘটনা স্মরণ করেই এই রীতি পালন । মেক্সিকোতে বড়দিনের উৎসব চলে অনেকদিন ধরে, ১২ ডিসেম্বর লা গুয়াদালুপানা নামের ভোজ দিয়ে শুরু হয় আর ৬ জানুয়ারি এপিফোনি ভোজ দিয়ে হয় শেষ ।

আমাদের দেশে বড়দিন মহা সমারোহতেই পালিত হয়, এদিন সরকারিভাবেই ছুটি থাকে । বড় বড় শহরগুলি আগে থেকেই রঙিন আলোয় সেজে ওঠে । কিছুদিন আগে পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের তামিলনাডু, কেরালা, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা তাদের বাড়ির ছাদে প্রদীপ জ্বালাতেন। কোথাও কোথাও আম ও কলা গাছের পাতা দিয়ে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হত, এখন উৎসবের ধরনধারণ যেমন বদলেছে উদযাপনের বহরও বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*