বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও অধিকার

বিপ্লব সৎপতি

Glocon-D না খেয়েও ভর দুপুরে সূর্য্য ও ভ্যাঁপসা গরমের সাথে লড়াই করতে করতে ডানপাশে ত্রিলোচন অটোমোবাইলের শোরুম,বাম পাশে থানাকে পিছনে রেখে, আমরা সিমলাপাল আটচালাগোড়া বাসস্টপে পৌছালাম। গরমে যা অবস্থা কোনোরকমে খাতড়াগামী বাসে উঠে লক্ষীসাগর পৌছালেই বাচি। ‘যোগ’ জলপ্রপাতের ন্যায় ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে সিনেমার হিরোদেরের রোমান্টিকতা আসে। ওসব আমার কর্ম নয়। তাই চোখ,মুখের ঘাম মুছে  দোকানের গায়ে সাঁটানো ‘বিক্ষোভ ও সমাবেশ, ১২দফা দাবী নিয়ে ধর্মতলা চলুন ‘ পোস্টারগুলি পড়ার চেষ্টা করছি। ছোটোবেলায় ‘কেন্দ্রসরকারের কালোহাত ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও’ শুনলেই মনে হত, এরা কতো বোকা  বাঁশের কঞ্চির উপরে পতাকা   না নিয়ে  মোটা  লাঠি নিলেই তো পারে।  যাইহোক হাতকে দূরবীন করে পড়ার চেষ্টা করছি। ভাবটা এমন যেন -যত কষ্ট হোক ওটা পড়তেই হবে। পাশে দেখি-‘সেও’ একবার রাস্তা নিয়ে গবেষণা করছে পরক্ষনেই আবার জুতো নিয়ে গবেষণা করছে। মানে এত নিখুঁত ভাবে একদৃষ্টি তাকাচ্ছে যে গবেষণার থেকে কম বলা যায় না।  ইতিমধ্যে খাতড়াগামী একটি বাস  স্টপে এসে ইঞ্জিন বন্ধ করেদিল। মিনিট পনেরো বাদে ছাড়বে। ভিড় হালকা কিন্তু সিট খালি নেই। ‘কাকের’ বসা আর ‘তাল’ পড়ার সম্পর্কের মতো, আমরা সামনের গেটে উঠা মাত্রই, সামনের গেটের সোজাসুজি দ্বিতীয় সিট থেকে একজোড়া নতুন দম্পতি নেমে গেলেন। তাদের আগের স্টপে নামার কথাছিল কিন্তু ভুলেগিয়ে আমাদের সুবিধা করেদিলেন। বাসের হাওয়া লাগলেই দুনিয়ার সবচেয়ে অসম্ভব কাজ কে সম্ভব করে তুলি। মানে ‘হলিউড’ সিনেমাগুলিকে আমেরিকা থেকে সমূলে উৎপাটিত করে বাঁকুড়াতে আছড়ে মারি। এই গরমে নায়ককে অবশ্য কষ্ট করে আসতে হয় না। এখানে ফ্রীতে একটা নায়ক পাওয়া যায়। কিন্তু আজকে ওসব ভাবলে চলবে না। আসার পর থেকে গরমের চোটে চারপাশে চিৎকার চেচাঁমেচি শোনাগেলেও,আমাদের মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে। অনেক কথাই বাকি  বাসে বলতে হবে, পাছে ‘হলিউডি’ চিন্তা মাথায় চলে আসে- তাই মাথাকে বারকয়েক ঝাঁকিয়ে নিলাম। ইতিমধ্যে বাসের হেল্পার বাস চাপড়ে সবাই কে জানান দিচ্ছে যে এবার বাস ছাড়বে। টিউশন পড়তে আসা কিছু ছেলেমেয়ে বাস ভিড় করে এমন জটলা করছে যে কথা বলার উপায় নেই। বাস চলতে শুরু করল, আমি চুপ করে আছি, চাইছিলাম শুরুটা পাশের সিট থেকে হোক।এর মধ্যে এক ভদ্রলোক আমার দিকে ঝুকে বিশ্ববিখ্যাত ডায়লগ বলে চলেগেলেন,’দাদা কোথায় নামবেন?।’ পরের স্টপেজে একজন মহিলা বছর আটেকের  একটি মেয়েকে কোলে নিয়ে সামনের গেটে উঠল।  মেয়েটি পোলিও খোঁড়া,মুখ দিয়ে লালা ঝরছে।এক কথায় প্রতিবন্ধী।  মহিলার হাতে ‘ঔষধ দোকানের ‘পলিথিলিন’ দেখে বোঝা যায়-হসপিটাল এসেছিল মেয়েটিকে ডাক্তার দেখাতে। আমার  বিপরীত দিকের ভদ্রলোককে দেখলাম, মাথা নামিয়ে মোবাইলে মন দিলেন।  চোখাচোখি হলে পাছে সিট চেয়ে বসে। মহিলাটি আমার সিট বাম হাতে  ধরে এর ওর দিকে অসহায় ভাবে তাকাচ্ছে। একবার মনে হল- আমরা দুজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। পুরো রাস্তা দাড়িয়ে গেলেও কিছু মনেই হবেনা।  এতএব সিট দুটো মহিলাকে দিয়ে দি। ‘পাশের জনের’ দিকে তাকিয়ে দেখি,’সেও’ ইশারায় একেই কথা বলছে। পরক্ষনেই ভাবলাম, আমরা কেন ছাড়ব? এটা তো পাবলিক বাস, প্রতিবন্ধী  যাত্রীদের জন্য একটি সিট রির্জাব আছে। আমরা সিট ছেড়ে দিলে,বাসের পাবলিক আমাদের দিকে প্রশংস্য দৃষ্টিতে তাকাবে। হয়তো বাড়ি ফিরে, চায়ের ঠেকে বন্ধুদের শোনানোর মতো একটি গল্প পেয়ে যাবো। কিন্তু ঔই মহিলাটির অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে কি? বাসে উঠলেই তো আবার কোনো দয়াবান মানুষের সিট ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কতকটা ধর্মীয় সংগঠন বা এনজিওর পূজোতে গরীব দুখিদের পোষাক বিতরনের মতো।এতে বিতরন কারীদের সামাজিক টেস্টাস বাড়ে কিন্তু গরীবদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। প্রশ্নটা যেখানে অধিকারের, দয়া বা অনুকম্পা কোনো স্থান পেতে পারে না।  সিট থেকে দাড়িয়ে বাসের কনডাক্টর  কে খোঁজার চেষ্টা করলাম। ভিড়ের মধ্যে দেখতে না পেয়ে, সামনে প্রতিবন্ধীদের জন্য রির্জাব সিটের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি, বছর কুড়ি বাইশের দুটি ছেলে সিট অধিকার করে নিজদের মধ্যে খোশ মেজাজে গল্প করছে। বললাম, ‘দাদা আপনাদের সিট ছাড়তে হবে। এই মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে বসবেন ‘। ‘ছাড়বো কেন!’, সামনের ছেলেটি বিস্ফারিত মুখ করে বলল। ‘সামনে কি লেখা আছে পড়ুন ‘,লেখাটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললাম। জানালাধারে যে ছেলেটি এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল,এবার সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,  ‘উঠব মানে! সেই বাঁকাদহ থেকে আসছি!ভাড়া দিয়েছি!কনডাক্টর আমাদের সিট দিয়েছে’। ‘সাথে মেয়ে আছে বলে হিরোগিরি দেখাচ্ছে ‘,প্রথমের ছেলেটি ফিসফিস করে বলল। আমি দৃঢ় কন্ঠে বললাম,’সেটা কনট্রাকটর ও আপনার নিজস্ব  ব্যাপার’। কিন্তু আপনাদের উঠতে হবে। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আগের যে ভদ্রলোক চোখ নামিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি বললেন,’উঠবেন না মানে! উঠে যান বলছি। ‘
তার দেখাদেখি বাসের হাতল ধরে দাড়িয়ে থাকা দু – তিনজন ভদ্র লোক,  একস্বরে চিংকার করে বললেন, ‘না উঠলে ভালো হবে না বলছি। ‘ এতজনের চাপে ছেলেদুটি কনডাক্টরকে শাসাতে শাসাতে উঠে গেল।’শালা আমাদের রাস্তা দিয়ে পেরোবি না।  দেখে নেবো। ‘ আমি বললাম, ‘দাদা কি সব মেয়ে হিরোইজম বলছিলেন না। ‘ কোনো উত্তর না দিয়েই ছেলে দুটি পিছন দিকে এগিয়ে গেল। এরপর আমি মহিলার দিকে ঘুরে বললাম, ‘ বসুন। আর শুনুন বাসে উঠলে মনে রাখবেন, আপনার মেয়ে সঙ্গে থাকলে একটি সিট পাওয়া আপনার  অধিকার। কারোর কাছে সিট চাওয়ার দরকার নেই।কনডাক্টরকে বলবেন, ব্যাবস্থা করে দেবে।’

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*