চৌরঙ্গী ময়দান ধরে খালি গায়ে হেঁটে চলেছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু

তপন মল্লিক চৌধুরী,

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রায়শই হাজির হতেন আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত-র বাড়িতে। স্কটিশ স্কুলের সামনে থেকে ধর্মতলাগামী একটা ট্রামে চড়ে ধর্মতলায় নেমে পায়ে হেঁটেই পৌঁছে যেতেন লিন্ডসে স্ট্রিট।

আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়নের ঘনিষ্ট সহচর। রাজনীতি, সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত আনন্দগোপাল সম্পাদনা করেছেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকা। তার সম্পাদিত এবং প্রকাশিত ‘সমকালীন’ পত্রিকা দীর্ঘ কয়েক দশক আধুনিক বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও শিল্প বিষয়ক মুখপত্র হিসাবে বাংলা পত্রিকার ইতিহাসে বিশেষ জায়গা দখল নিয়ে আছে।

আনন্দগোপালবাবুর ডেরাটি ছিল অধুনা লিন্ডসে স্ট্রিট-এর কাছে চৌরঙ্গী ওয়াইএমসি-এর পিছন দিকে। জায়গাটি এবং মানুষ আনন্দগোপাল সত্যেন বসুর খুব প্রিয় পাত্র ছিলেন। সে কারণেই তিনি প্রায়শই হাজির হয়ে যেতেন ওই ডেরায়।

এক রবিবারের সকালের কথা। সত্যেন বসু আনন্দগোপালবাবুর ডেড়ায় হাজির হয়েই বললেন, ‘কফি খাওয়া’। এরপরই ফতুয়াটি খুলে রেখে গা এলিয়ে দিলেন ইজিচেয়ারে। খালি গায়ে চোখ বুজে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে কফি খেতে খেতে মেতে উঠলেন নানা গল্পকথায়। তার কথার মধ্যে বিষয় হিসাবে কি না থাকত। অঙ্ক কিংবা ফিজিক্স থাকত না। ছেলেবেলা, নানাধরণের মানুষ থেকে শুরু করে রান্নাবান্না মানে নানা পদের রেসিপি এসবই থাকত বেশী করে।

ইতিমধ্যে সেখানে এসে হাজির রাজ্যপালের এডিকং। স্যালুট ঠুকে সে জানাল স্যারের বাড়ি গিয়েছিল সে ওখান থেকেই এখানকার ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। হিজ একসেলেন্সি (তখন এমনটাই বলা হত) গাড়ি পাঠিয়েছেন, স্যারকে নিয়ে যেতে বলেছেন। সত্যেন বসু তাঁকে জানালেন, ‘তুমি এগিয়ে যাও আমি আসছি’। এডিকং চলে যাওয়ার পর সত্যেন বসু আনন্দগোপালকে বললেন, ‘চল তাহলে যাই, দেখি কেন জরুরী তলব’।

রাস্তায় বেড়িয়ে আনন্দগোপাল বললেন, ‘ স্যার একটা ট্যাক্সি ডাকি?’ সত্যেন বসু বললেন, ‘না; চল সবুজ মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটেই যাই’। তাই হল; ভুবনখ্যাত বিজ্ঞানী উদোম শরীরে ভুঁড়ি দুলিয়ে হেলে দুলে চলতে থাকলেন আর আনন্দগোপালকে বলতে লাগলেন ফুলকপি আর কচু রান্না কীভাবে করতে হবে, কচু আর পটলের তরকারিতে কি কি দিলে তার স্বাদ অমৃতের মতো হয়। চৌরঙ্গীর ময়দান, সবুজ ঘাস, খোলা হাওয়া সবাই দেখলো জাতীয় অধ্যাপক সত্যেন বসু হাঁটছেন  খালি গায়ে আর তাঁর ফতুয়াখানা নিয়ে পিছু পিছু চলেছেন আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত।

ওইভাবেই একসময় তাঁরা পৌঁছে যান লাটভবনের উত্তরদিকের গেটে। আনন্দগোপাল বললেন,’ স্যার এবার ফতুয়াটা গায়ে দিয়ে নিন। সত্যেন বসু বললেন, ‘থাক না, বড্ড গরম’। আনন্দগোপাল একটু প্রতীবাদের সুরে বললেন, ‘ তা কি করে হয় স্যার গভর্নর বলে কথা, ডেকরাম বলে তো একটা ব্যাপার আছে’। সত্যেন বসু ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ বলছিস; তাহলে পরিয়ে দে’। দু’হাত প্রসারিত করে দিলেন সত্যেন বসু দাঁড়ালেন আর আনন্দগোপাল তাঁকে ফতুয়া পরিয়ে দিলেন। ওই দৃশ্য স্বল্প দূর থেকে দু’চোখ মেলে দেখল লাটভবনের নিরাপত্তারক্ষী থেকে শুরু করে বিভিন্ন অফিসাররা। বছরের প্রথম দিনটি  সেই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর জন্মদিন।  

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*