ভূতের থেকেও ভূতুড়ে

শনিবার নয় রবিবারের বারবেলা। আপনারা পাবেন গা ছমছম করা বেশকিছু গল্প। হতে পারে তা ভূতের গল্প বা রোমাঞ্চকর। এমনই ধারাবাহিক গল্প পড়তে চোখ রাখুন রোজদিনে….

আজকের গল্পঃ ভূতের থেকে ভূতুড়ে
মাসানুর রহমান

বেশ কয়েকদিনের ছুটি পেয়েছি অফিস থেকে। বেসরকারি চাকুরির জাঁতাকলে পড়ে জীবন পুরোটা তেজপাতা হয়ে গেল। সকালের সূর্যোদয় আর রাতের ঘনকালো অন্ধকার ছাড়া পুরো সপ্তাহে আর কোনকিছুই চোখে পড়েনা। বীরভূমের বাস আজ দেড় ঘন্টা দেরি করেছে। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে কম হলেও দেড়টা-দুটো বাঁজবেই। হুট করে বাড়ি যাচ্ছি, জানিয়ে গেলে অনেক ধরনের উটকো সমস্যা। এই যেমন, একটু পর পর বাবা ফোন করবে, কোথায় আছি, কি করছি জানতে চাইবে ? অনেকদিন পর বাড়ি ফিরবো বলে মা আবার হাজার রকমের পিঠে বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ফলাফল, ছুটি শেষে শহরে ফিরে আসতে কষ্ট হবে। তার চেয়ে বরং না জানিয়ে চলে আসছি, দু’একদিন থাকবো তারপর ছুটি শেষে ঠিকঠাক চলে যাবো!

এখন প্রধান সমস্যা হল, বাজার থেকে বাড়ি ফিরব কি করে ? বারোটা পর্যন্ত বাজার খোলা থাকে এরপর ধীরে ধীরে সব বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে, এক স্টেশন আগেই বাস থেকে নেমে যেতে হবে। বাস থেকে নেমে উত্তরের ধানক্ষেতটা ধরে দু-তিন মাইল জায়গা হাঁটতে হবে। বাবাকে এই মাঝরাতে ফোন করা ঠিক হবে কিনা একবার ভাবলাম। নাহ, প্রয়োজন নেই বুড়ো মানুষটাকে এত রাত্রে ঘুম থেকে জাগানোর।

মাঝে মাঝে বাস থামছে লোক নামছে। ওঠার কোন প্যাসেঞ্জার নেই। এতো রাতে কে উঠবে। যারা আছে তার সবাই বাস থেকে নেমে বাড়ি যাচ্ছে। আমি ঘড়ির দিকে তাকাই। ঠিক দেড়টা নাগাদ বীরভূম এসে বাস থামলো। দেখলাম তখন আমরা বাসে মাত্র সাতজন যাত্রী। আমিই একমাত্র এই নির্জন জায়গায় নামলাম। উপায় নাই। আর কেউ নামলো না। আমাকে নামিয়ে দিয়ে বাস চলে গেলো। চোখে অন্ধকার দেখছি। চারদিক ঘুট ঘুটে অন্ধকার। একবারে শুনসান। ধারে কাছে কেউ নেই। একটু আলোর চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না। বাসের পেছনের লাল লাইটটা ক্রমশঃ অন্ধকারে মুখ ঢাকা দিলো।

পকেট থেকে ফ্ল্যাসওয়ালা মোবাইলটা বের করলাম। হায় কপাল লো ব্যাটারি দেখিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশটা কেমন লাল। এতো অন্ধকার হাত পনেরো দুরের রাস্তাটুকু খালি দেখতে পাচ্ছি তারপর ঘুটঘুটে অন্ধকার সব কিছু গ্রাস করে নিয়েছে। জোনাকি পোকাগুলোর ইতি উতি আলোটুকু পর্যন্ত নেই। ঝিঁঝিঁপোকাগুলো অনবরত ডেকে চলেছে । ভীষণ বিরক্ত লাগলো। ভাবলাম একবার সামনের বাজারেই পুরো রাতটা কাটিয়ে দিই। ভোর সকালে গাঁয়ের লোকেরা আমায় ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে আবার কি ভাববে। তাছাড়া এতোরাতে বাজারেও কেউ জেগে থাকে না। বুঝলাম আজ কপালে আমার অশেষ দুর্গতি। যদি এখান থেকে একটা রিক্সাও থাকতো তবে বিশ টাকার ভাড়া দেড়শ টাকা দিয়ে বাড়ি চলে যেতাম। খুব তাড়াতাড়ি হাঁটলেও আমার আড়াই ঘন্টা লাগবে এই অভিশপ্ত রাস্তাটুকু পার হতে। যতই আমি গ্রামের ছেলে হই। আজ প্রায় দশ বছর গ্রামের বাইরে। বছরে একবার কিংবা দু’বার আসি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করলাম। পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরালাম। পকেটে টর্চ নেই তবে ছাতাটা আছে। মা বার বার বলতেন, শীতের কাঁথা আর বর্ষার ছাতা সবসময় সঙ্গে রাখবি। দেখবি পথে ঘাটে কখনো অসুবিধে হবে না। এতদূর কিভাবে যাব এই ভাবতেই বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেলো। কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা, কেবল মাথা চুলকাচ্ছি আর ভাবছি।

বাদল মিঞ্চার পরিত্যক্ত ভিটে। এ ভিটে নিয়ে গ্রামে অনেক লোকের অনেক কথা প্রচলিত আছে। সন্ধ্যে হলেই এ পথ কেউ মাড়াতে সাহস করেনা। বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। সামান্য হাওয়া দিচ্ছে। বাঁশ গাছ গুলো নড়ছে। ক্যাঁচর ক্যাঁচর একটা আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে দোয়া-দরুদ পড়া আরম্ভ করলাম। আকাশের দিকে তাকালাম। মুখটা কেমন ভার ভার , বুঝলাম বাড়ি পৌঁছুবার আগে ঝড় উঠতে পারে। হেরে গলায় গান গাওয়া শুরু করলাম , যতো তাল দিয়েই গান গাইছি না কেন ম্লান লাগছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ইংরেজিতে বে – সুরে গান গাইতে আরম্ভ করলাম। কোন গানই পুরো গাইতে পারি না। সব কেমন যেন ছোট ছোট হয়ে যাচ্ছে। তিতিক্ষার শেষ। করিম মিঞার ভিটে পাড় হলাম। এবার কামালপুকুর। এ পুকুর নিয়ে শোনা ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভাসমান হতে লাগল। হঠাৎ, কালো রঙের একটা কুকুর পাশ কাটানোর জন্য উতলা হয়ে গেল। নিজের ভবিষ্যৎ পরিণতি বুঝতে আর বাকি রইলোনা। দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করছি কিন্তু তবুও কেন জানি পথের দূরত্বটা অনেক মনে হচ্ছে। মা-দাদুর কাছে শুনেছিলাম, মাঝরাত্রে নাকি পুকুরের জল ফুঁড়ে একদল মানুষ বের হয়ে আসে। কাফনের কাপড় পরা লাশ কাঁধে পুরো পুকুর প্রদক্ষিণ করে। ফজরের আযানের আগে আবার নাকি বাতাসে মিলিয়ে যায়। গাঁয়ের অনেকেই ব্যাপারটা চোখে দেখেনি তবে পূর্বসূরি অনুসারে শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। শরীরে হালকা কাঁপুনি অনুভব করলাম। এখন রাত দুটো নাগাদ হবে। এখনো প্রায় হাফ কিলোমিটার ! মাঠের শেষ প্রান্তে একটা হাল্কা রেখা দেখা যাচ্ছে। আলোর চিহ্নমাত্র নেই। কুয়াশামতন একটা জিনিস বাতাসে ভর করে আমার দিকে ভেসে আসছে। পিলে চমকে উঠার মত অবস্থা। মনে মনে ভাবলাম নাহ..! আলোই ভালো। রাত্রিবেলার এই অদ্ভুত ভয়ংকর জিনিষ থেকে তো অন্তত দিনের বেলাতে বাঁচা যায়। এই এতোবড়ো ফাঁকা মাঠে দু – তিনটে বট অশ্বত্থ গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। গলা ছেড়ে আবার গান ধরলাম।

(ক্রমশঃ পরের সপ্তাহ)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*