মনস্তত্ত্ব

নিজামউদ্দিন মোল্লাঃ

নিয়ম টা কি জিনিস? জগতে কি সব নিয়ম মানা উচিত? না নিয়ম – অনিয়মের মাঝামাঝিতে হয়ত সবাই আঁটকে। এই কথাটাই বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠল রঘুনাথ দত্ত। আমি শুনেই একটু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, দেখি রঘুনাথ বাবু খবরের কাগজ টা ভাঁজ করছে। আমি তখনই বলি, ” কি দত্ত বাবু, খবরের কাগজে এসব লেখা আছে নাকি?”

“হ্যা। কি আর বলব কয়েকদিন থেকেই এই দৈনিক পত্রিকাটিতে ‘মনস্তত্ত্ব ‘ বলে একটা হেডিং দিয়ে কয়েক লাইনের আজব কথা লিখছে।”

“তা বেশ। কিন্তু তোমার কি মনে হয়, নিয়ম আর অনিয়মের মাঝেই কি সবাই অতিক্রম করছে?”

” তা ঠিক, কিন্তু কি জানেন রণজিৎ বাবু!” এই বলেই চুপ করে গেল। আমি তখন আবার জিজ্ঞাসা করলাম,” তা কি!”

“মানুষ নিয়ম মানে না। নিয়মের অনুসারীরা এই দুনিয়ায় তাদের বাসস্থান নেই বললেই চলে।” কথাটা হাসতে হাসতে দত্ত বাবু।

কিছুক্ষণ আমরা দুজনেই চুপচাপ। অফিসে কাজ প্রায় শেষ, দেখলাম দত্তবাবু ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে, তাই দেখে আমারও মনে সেই একই লোভ জন্মালো, মনে মনে বললাম, “দূর আমিও এবার পালাই।”

এবারে গোড়ার কথা বলি, আমি কলকাতা শহরে এক সাধারণ চাকুরীজীবী মানুষ।আর আমার সেই অফিসের সহকর্মী, যেখানে আমি চাকুরী করি,সেই সহকর্মীর নাম শ্রী রঘুনাথ দত্ত। প্রায় কুড়ি বছ্অর এই অফিসে কাজ করছি, আমি যখন প্রথম এখানে কাজে যুক্ত হয় তখন থেকেই রঘুনাথ দত্ত বাবুকে দেখছি। একদিন ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,”আচ্ছা আপনি কতদিন এখানে কাজ করছেন?”

উনি একটু হাসতে হাসতেই বললেন, ” এই তো দুবছর হল। কিন্তু আপনি এলে এখন একটা কথাবার্তার লোক পেলাম।নাহলে কি জানো! খুব বোরিং লাগে এখানে।”

আসলে রঘুনাথ বাবু খুবই হাস্যরসিক মানুষ। বাড়িতে তাঁর একটা কন্যা ও একটা পুত্রসন্তান আছে। তাদের সঙ্গে অনেক আগেই দেখা হয়েছে।তাদের দুজন আমাকে ছোটবেলা থেকেই দেখছে। শেষে তিনবছর হল তাদের সাথে আর দেখা হয়নি। কে জানে তারা কেমন আছে? তারা খুব অসহায় অল্পবয়সে জননী হারা হয়েছে।

সোহা হল রঘুনাথ বাবুর মেয়ে, খুবই সরল আর দেখতেও খুবই সুন্দরী। আর সোহার ভাই সে তো ঠিক রঘুনাথ বাবুর মতই হাসিভরা মুখ, যেন জগতে এই মুখ দুটি বিরল।

সোহার বয়স হবে আজকের দিনে প্রায় একুশ। আর তার ভাই পনেরো। সে এখন পাগল,মাথার ঠিক নেই। রঘুনাথ বাবুর তাই খুবই অসহায় বোধ করে।ওনার ছেলের নাম টাই বলা হয়নি।অত সুন্দর দেখতে তাই তার মা বিক্রম নাম টাই রেখেছিল।কিন্তু সেই বিক্রম থেকে কিভাবে বিলু নামধারণ করল সেটা খুবই সহজ ও সাধারণ।

সোহা যখন উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছিল তখনই তাদের উপর বাজ পড়েছিল। প্রথমে রঘুনাথ বাবুর পরিবারের কথাই বলি, খুবই সাধারণ ও নিয়ম মাফিক তাদের জীবন। আসলে সোহা স্কুলের পড়াশোনার সময় একটা গুপ্ত প্রেমের মধ্যে ছিল।কেউ জানত না, কিন্তু অল্পবয়সী প্রেম কি প্রেম হয় সেটা তো আবেগ। আর আবেগকেন্দ্রিক কিছু স্থায়ীত্ব হয় না।

একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম বিলুকে,”আচ্ছা তোমার তো অনেক বন্ধু তা বেস্ট ফ্রেন্ড কে?”

বিলু যে উত্তর টা দিয়েছিল তা সত্যি এখনো আমার মনে গাঁথা আছে। বলল, “কেন আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তো আমার দিদি।” কথাটা যেভাবে বলেছিলো বুঝেছিলাম ওর দিদি ছিল ওর জীবন। আমি দেখেছিলাম ওরা কতই ভালো বন্ধুত্ব।দেখেছিলাম ওদের নিজেদের নাড়ির টান।

কিন্তু সে সুখ কি বেশি দিনের, বিলুর আজ এ অবস্থা তার দায়ী কি? কি দোষ করেছিলো তারা! ওই বিলু দেখেছিল তার দিদির আত্মহত্যা নিজের চোখের সামনে।

ঘটনাটা হয়েছিল উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষার সময়, সেদিন ইতিহাস পরিক্ষা দিতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যায় কিন্তু বাজ তখনই পড়ে যখন ডাক্তার বলে সোহার দেহের মধ্যে একটা সন্তান আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে। এই কথা টা শুনেই রঘুনাথ বাবুর অবস্থা টা সত্যি বেদনাহত ও ভয়ঙ্কর। রঘুনাথ বাবু তার প্রিয় কন্যাকে কিছুই বলল না শুধু চোখের জল টাই ডান হাতের তর্জনী দিয়ে মুছে নিল।আর সেইদিন রাতে যে ঘটনা টা ঘটল তা যে বিলু নিজের চোখে দেখেছিল সেটা দেখা কি ভয়ঙ্কর তা হয়ত বিলুই জানে।

সেইদিন রাতে সোহার ঘুম হল না, পাশেই শুয়ে আছে ছোট ভাই বিলু।সে ঘুমন্ত। মধ্যরাত্রি পেরিয়ে, রাত্রি গভীর হয়েছে হটাৎ সোহার মাথায় সাক্ষাৎ শয়তান ভর করল।সে গিয়ে দরজায় খিলটা বন্ধ করল, তারপর ঘুমন্ত বিলুর হাত দুটো ও পা দুটোকে খাটের সাথে বেধেদিল নিজের ওড়নাগুলো দিয়ে। তারপর পুরানো আরকিছু ওড়না দিয়ে পাখায় বাধল।একটা ফাঁস দিল, তার মধ্যে নিজের গলা সেই ফাঁসের মধ্যে দিয়ে ঝুলে পড়ল। কিছুক্ষণ আর্তনাদ করল, সেই শব্দেই বিলুর ঘুম ভেঙে গেল।কিন্তু সেই যে দৃশ্য টা দেখল তা হয়ত সে কখনোই কল্পনা করতে পারেনি।

সেদিনের পর থেকে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না বিলু, এদিকে রঘুনাথ বাবুর ও মনে একটা আঘাত লাগল। সেই আঘাত আজ ফুটে উঠল, সেই ক্ষত আজ দেখা দিল। যখন সংবাদপত্রের সেই মনস্তত্ত্ব অংশ টা পড়ল তিনি নিয়মের খেলায় নিজেকে অনিয়মে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবল, হয়ত তিনি ভাবনা কে নিয়মের সাথে মিশিয়েছে, ভেবেছে মানুষের জীবনে এই রকম কতগুলো নিয়ম থাকে যা কষ্ট দিতে থাকে অনবরত। আসলে মেয়ে হারানো কষ্ট এক বাবাই জানে, কিন্তু সঙ্গে বিলু সেও তো হারিয়ে গেছে, শুধু দেহটাই তার টিকে আছে।

“আসলে ভালোবাসার নিয়ম আছে,একটা হল স্নেহ, মমতা দিয়ে বাঁধা।আর একটি নিয়ম হল কাম।”

এই নিয়মের বেড়াজালে আঁটকে আছে সভ্যতা, সমাজ ও মানুষ।

—-সমাপ্ত

1 Comment

  1. অসাধারণ , খুব সুন্দর লাগলো , মন্ত্রবিমুগ্ধ হলাম পড়ে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*