পুজোয় মুক্তি পাওয়া ছবিতে এখনও এক নম্বরে উত্তমকুমার

তপন মল্লিক চৌধুরী,

 ( ১ম কিস্তি  )

আজ থেকে ৬১ বছর আগে পুজোতেই মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’, ৫৪ বছর আগে ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ মুক্তি পেয়েছিল পুজোর সময়েই। ঋত্বিক ঘটকের আর কোনও ছবি পুজোতে মুক্তি পায় নি তবে সত্যজিৎ রায়ের অনেক ছবিই মুক্তি পেয়েছিল পুজোর সময়ে। তার মধ্যে ‘অভিযান’ (১৯৬২), ‘মহানগর’ (১৯৬৩), ‘চিড়িয়াখানা’ (১৯৬৭), ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০), ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১) উল্লেখযোগ্য। প্রসঙ্গত; উত্তমকুমারের বহু ছবি মুক্তি পেয়ছিল পুজোতেই। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ইন্দ্রাণী’ (১৯৫৬), ‘সোনার হরিণ’, ‘অবাক পৃথিবী’ (১৯৫৯), ‘দুই ভাই’ (১৯৬১), ‘মোমের আলো’ (১৯৬৪), ‘সূর্যতপা’ (১৯৬৫), ‘শঙ্খবেলা’ (১৯৬৬), ‘চিড়িয়াখানা’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ (১৯৬৭), ‘চৌরঙ্গী’, ‘তিন অধ্যায়’ (১৯৬৮), ‘মন নিয়ে’, ‘কমললতা’ (১৯৬৯), ‘নিশিপদ্ম’ (১৯৭০), ‘জীবন জিজ্ঞাসা’ (১৯৭১), ‘মেম সাহেব’ (১৯৭২), ‘রৌদ্রছায়া’ (১৯৭৩), ‘অমানুষ’ (১৯৭৪), ‘প্রিয়বান্ধবী’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’ (১৯৭৫), ‘নিধিরাম সর্দার’ (১৯৭৬), ‘আনন্দ আশ্রম’ (১৯৭৭), ‘ধনরাজ তামাং’ (১৯৭৮), ‘শ্রীকান্তের উইল’ (১৯৭৯)। ছবির নাম বলতে গেলে তালিকাই লম্বা হবে। তবে পুজোর ছবি বললেই উত্তমকুমার একাই একটা বড় জায়গা দখল করে নেন।

১৯৫৩ সালের পুজোয় মুক্তি পেয়েছিল ‘‌বউ ঠাকুরানির হাট’‌। তখনও উত্তম ‌মহানায়ক হয়ে  ওঠেননি, কিন্তু পুজোতে মুক্তি পাওয়া তার প্রথম ছবি হিট করেনি। অথচ পরের বছর ১৯৫৪–‌র পুজোতেই ছিল উত্তম–‌সুচিত্রার সেই বিশাল বক্স অফিস হিট ছবি ‘‌অগ্নিপরীক্ষা’‌। ১৯৫৭-তে ‘‌অভয়ের বিয়ে’ ‌পুজোর সময় মুক্তি পেলেও ছবিটি বানিজ্যিক সাফল্য পায়নি ঠিকই, তবে পুজোর কয়েক সপ্তাহ আগে মুক্তি পাওয়া ‘হারানো সুর’ পুজোর পরের দু’সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও হলের সামনে হাউস ফুল বোর্ড। ‌এরপরে পুজোর সুপার হিট ছবির মধ্যে উল্লেখ করতে হয় ১৯‌৬১-র ছবি ‘সপ্তপদী’। আগের পুজোর সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দেয় উত্তম-সুচিত্রা জুটির এই ছবিটি। সেবার পুজোতে একই সপ্তাহে মুক্তি পেয়েছিল আরও একটা ছবি ‘দুই ভাই’, সেই ছবিটিও দারুনভাবে সফল হয়েছিল।  

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কিন্তু পুজোর ছবিতে উত্তম ব্যর্থ হন। তার আগে সুচিত্রার সঙ্গে তাঁর জুটি ভেঙে গিয়েছে। ১৯৬৪ সালের পুজোয় মুক্তি পেল ‘মোমের আলো’, এই ছবিতে সুচিত্রার বদলে নায়িকা সাবিত্রী। উত্তমকুমারের পুজোর ছবি ফ্লপ করল। অন্যদিকে হিট করল সুচিত্রা সেনের ‘‌সন্ধ্যাদীপের শিখা’‌। পরের বছর  অবশ্য ‘সূর্যতপা’‌ হিট করল। ’‌৬৬–তে ‘‌শঙ্খ বেলা’‌, ’‌৬৭–তে ‘‌অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’‌ ও তাই। উত্তমকুমারের তিন নতুন নায়িকা সন্ধ্যা রায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, তনুজা পারলেন সুচিত্রা ছাড়া উত্তমকে হিট করাতে। প্রসঙ্গত,‌ ’‌‌৬৭–তে আবার পুজোর আগের সপ্তাহেই মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘‌চিড়িয়াখানা’‌। ’‌৬৮–তে পুজোতে জোড়া উত্তম। ‘‌চৌরঙ্গী’‌, ‘‌তিন অধ্যায়’‌ দুটোই হিট। ১৯৬৯ সালে ফের জুটি বাধলেন সুচিত্রা-উত্তম, হরিসাধন দাশগুপ্তের ‘‌কমললতা’–য়।‌ পুজোয় সে ছবি মুক্তি পাওয়ায় স্বভাবতই সাড়া মিলল। প্রায় একই সময়ে মুক্তি পেল ‘‌মন নিয়ে’‌, নায়িকা সুপ্রিয়া দেবী। সেবার পুজোয় একটা চাপা উত্তেজনা টলিউডের হাওয়ায় পাক খেয়েছে এবং তা জনমনেও কৌতূহল সৃষ্টি করেছিল- কে বেশি সাফল্য এনে দেবেন উত্তমকে?‌ সুচিত্রা নাকি সুপ্রিয়া? ‌ প্রযোজক-পরিবেশকদের হিসাব অনুসারে দু’‌টো ছবিই প্রায় একইরকম ব্যবসা দিয়েছে।

তবে সাতের দশকে এসে হিসেব নিকেশ একটু একটু  করে হলেও বদলে যেতে শুরু করল। দেখা গেল সত্তরের দশকের একেবারে গোড়াতেই পুজোর সামান্য আগে মুক্তি পাওয়া ‘‌রাজকুমারী’‌ বক্স অফিসে কোনও সাড়া ফেলতে পারল না। কিন্তু একই সময়ে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘‌নিশিপদ্ম’‌ সুপার হিট। সত্তরের দশকের গোড়ার কয়েকটা বছর রাজনৈতিক কারণেই সামাজিক পরিস্থিতি অশান্ত ছিল। তার ছায়া পড়েছিল বাংলা সিনেমা পাড়াতেও। যাইহোক ১৯‌৭১ থেকে ’৭৩-‌এর পুজোতে উত্তমকুমারের একক কৃতিত্বে ‘‌জীবন জিজ্ঞাসা’ ‌ ছাড়া আর কোনও ছবি হিট করেছে এমনটা বলা যায় না। ‘‌মেমসাহেব’, ‌ ‘‌ছিন্নপত্র’, ‘‌রৌদ্র ছায়া’ ছবিগুলিকে কোনওভাবে হিট ছবি বলা যায় না। ‌বরং ১৯৭৩ সালে সুপারহিট করল কিশোর নায়ক–‌নায়িকা অভিনীত তরুণ মজুমদারের ছবি ‘‌শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’‌। বোঝা গেল বক্স–‌অফিস বদলাচ্ছে। পাশাপাশি গুঞ্জন ছড়াল উত্তমকুমারের দিন শেষ।  (চলবে )

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*