পরকীয়া

পায়েল খাঁড়াঃ

“পারিনি জানতে কখন কিভাবে কোথায়?
আমার সুখটা আমাকেই ভুলে মাতলো পরকীয়ায়।”
আবৃতিটা শুনতে শুনতে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়েছিল ইরা,চমক ভাঙল হাততালির অনুরননে।
হল থেকে বেরোতে বেরোতে মেখলা জিজ্ঞাসা করল ‘তোর কি হয়েছে বলত ইরা। ক’দিন ধরেই তোকে কেমন যেন ডিস্টার্বড দেখাচ্ছে__ব্যপার কি?রজতদার সাথে কোন ঝামেলা……’
‘আরে না না সেসব কিছু নয়__আসলে—’
কথাটা বলে একটু থামল ইরা।ওর কপালে চিন্তার গাড় রেখা।মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় নিজের সাথেই একটা ভীষন দ্বন্দ্ব চলছে ইরার।আলতো করে নিজের হাতটা ইরার কাঁধে রাখল মেখলা।বলল, ‘কি হয়েছে__আমায় বল?’
‘আমি একটা খুব বড় ভুল করে ফেলেছি রে।’
‘ভুল—কি ভুল?’সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করল মেখলা।
‘সুনিতার বাড়িতে পার্টিটা মনে আছে। সেখানেই ব্যপারটার শুরু।তোর পরেরদিন সকালেই ফ্লাইট ছিল বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলি।তারপর সুনিতা আমার আলাপ করাল উজানের সঙ্গে।উজান একজন আর্টিস্ট,ওর বেশ কয়েকটা ছবিও দেখলাম।ভীষন অদ্ভুত আর ফ্যাশিনিয়েটিং ওর প্রতিটা আর্টপিস।সাধারন চোখে দেখলে কিছুই বোঝা যায় না কিন্তু সুক্ষ্মভাবে প্রতিটা থট ভীষন গভীর, কিনলি জাস্টিফায়েড।
প্রথম থেকেই খেয়াল করেছিলাম উজান আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে।মেয়েরা আর যাই পারুক না পারুক পুরুষমানুষের দৃষ্টিকে বুঝতে অসুবিধা হয়না তাদের।প্রথমটা ব্যপারটায় আমল না দিলেও পরে বুঝতে পারলাম সেই আকর্ষনের ছোঁয়াচ কখন আমার গায়েও লেগেছে।পুরো সন্ধ্যেটা প্রায় ওর সাথে গল্প করেই কাটিয়েছিলাম।মোবাইল নম্বর অ্যাড্রেস সব দিয়ে ফেললাম।আমার বাড়িতে কোনদিনও আসেনি উজান কিন্তু আমরা মিট করতে লাগলাম বিভিন্ন জায়গায়।
এত অল্পসময়ে একটা অচেনা মানুষের সাথে এতখানি ঘনিষ্ঠতা—জীবনে প্রথম ছিল সে উপলব্ধি।মন খুলে এত কথা বলা__অন্য কেউ দূরে থাক রজতের সাথেও তো কখনও বলিনি আমি!হয়ত বলার সময় বা সুযোগ কোনোটাই দিতে পারেনি রজত।
তুই তো জানিস রজত বরাবর’ই ভীষন কাজপাগল।অফিস মিটিং ট্যুর এসবের বাইরে কোন কিছুতেই ওর ইনভল্ভমেন্ট ছিলনা কখনও।এমনিতে ও আমাকে সব দিয়েছিল—ভালোবাসা সম্মান স্বাধীনতা সুরক্ষা।আমি জানতাম যে আমি সুখী;আই অ্যাম লিডিং এ পারফেক্ট লাইফ কিন্তু—কিন্তু যতই উজানের সাথে মিশতে লাগলাম ততই সেই পারফেক্ট লাইফের খুঁতগুলো আমার চোখে বিঁধতে লাগল।মিসেস রজত গুপ্তের বাইরেও যে আমার একটা আলাদা অস্তিত্ব আছে,সেটা যেন বারে-বারে’ই কেউ আমায় মনে করিয়ে দিতে লাগল।
এইপর্যন্ত বলে ইরা থামল।
-তারপর ?
-তারপর আলাপটা বদলে গেল বন্ধুত্বে আর কখন যে সেটা বন্ধুত্বের সংজ্ঞা ছাড়িয়ে একটা অজানা সম্পর্কের সুত্রপাত ঘটিয়ে ফেলল আমি টেরও পেলাম না।উজানের ব্যাক্তিত্বে এমন কিছু একটা ছিল যেটার আকর্ষন কাটিয়ে ওঠা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিলনা আমার পক্ষে—সেটা বারবার বাধ্য করছিল আমায় নিজের গন্ডি ভাঙতে।সব বেড়া ভেঙে এলোপাথাড়ির মত ভেসে যেতে উজানের স্রোতে। আর একদিন গেলাম ও তাই।
ঝাপসা অন্ধকারে মেখলা দেখল ইরার দৃষ্টিটা উত্তেজনায় ধকধক করছে।একটা সাদামাটা মেয়ে, যে জীবনের পাওনাগুলোতেই সন্তুষ্ট থাকতে শিখে ফেলেছিল,আলাদা করে কোনো চাহিদা যার ধর্তব্যের মধ্যেও আসতো না তার জীবনে সম্পর্কের এমন ঘুর্নিঝড়—অবিশ্বাস্য লাগছিল মেখলার।
ইরা আবার শুরু করল,
-সেদিন আমাদের বিবাহবার্ষিকি ছিল।সকালের ফ্লাইটে ফেরার কথা ছিল রজতের।ও বলেছিল পুরো দিনটা আমরা একসাথে কাটাবো।অনেকদিন পর একটা পুরো দিন রজতকে কাছে পাবো।ভীষন এক্সাইটেড ছিলাম সকাল থেকেই। হটাৎ ফোন এল ও ফিরতে পারবে না—খুব জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে।
এক মুহুর্তের মধ্যে আমার কল্পনার আয়নাটা ভাঙা কাঁচের মত ছড়িয়ে গেল।রজতের এমন খামখেয়ালিপনায় আমি অভ্যস্তই ছিলাম।তবু সেদিন কেন জানিনা ভীষন রাগ হয়েছিল ওর উপর।আমার অভ্যস্ত আপোসগুলো থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল।আর ঠিক তখনই উজানের ম্যাসেজ এল,মন্দারমনিতে ওর একটা এক্সিবিশন ছিল।ও চাইছিল আমায় সঙ্গে নিয়ে যেতে।
অভিমানের পারাটা আমার ভালো-মন্দের সমঝটাকে একেবারে ঝাপসা করে দিয়েছিল।কোনদিক না ভেবেই হ্যাঁ বলে দিলাম।
মন্দারমনির নিঃসঙ্গ ঝাউবেলা, দিগন্ত ছুঁয়ে আসা অবাধ্য ঢেউ আর সে’সবকিছুকে ছাপানো উজানের রোমাঞ্চিত সান্নিধ্য—বাকি পৃথিবীটা থেকে যেন আমার যোগসূত্রটাই বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল,আমি ভুলে গেছিলাম আমার আসল পরিচয়।
আমার লজ্জা সামাজিকতা আড়ষ্টতা সবটাকে ডিঙিয়ে ভীষণ কাছে চলে এল উজান। ওকে বাধা দেবার সাধ বা সাধ্য কোনোটাকেই যেন খুঁজে পেলাম না নিজের মধ্যে,শুধু একটা অবান্তর সাধ আর অবাধ আসক্তি পেয়ে বসেছিল আমায়।একটু একটু করে হারিয়ে ফেলছিলাম নিজেকে ওর চোখের সম্মোহনে।

ইরার ঠোঁটে আবারও একপ্রস্থ নিস্তব্ধ বিরতি দেখা দিল।নিজের আবেগ আর অন্তরঙ্গতা’কে এভাবে উন্মুক্ত করা কোনো মেয়ের পক্ষেই সহজ হয় না,কিন্তু ওর বুকে জমা পাথরটায় এটুকু রেগোলিথের প্রয়োজনটা একরকম আবিশ্যিক’ই ছিল।
ইরা আবার বলতে শুরু করল,
-পরের দিন সম্বিত যখন ফিরল তখন আমি লজের রুমে মেঝেতে শুয়ে আছি।ভোরের আলোটা তখন সবে ফুঁটছে।ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম,শালোয়ারটা আগোছালো—হুকগুলো খোলা, ওড়নাটা নেই।তাকিয়ে দেখলাম দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ,মোবাইলে উজানের একত্রিশটা মিসডকল।গতকালের ঘটনাগুলো জট বেঁধে মাথাটা যেন ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল।একটা ঘেন্না মাখানো চিৎকার যেন গলার কাছটায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছিল।কাউকে কিছু না বলেই কোনোরকমে লজ থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা কলকাতায় চলে এলাম।

ইরা থামল,জমাট অপরাধবোধটাকে খালাস দিতে পেরে নিজেকে অনেক হালকা লাগছিল তার।ওর কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে মেঘলা বলল—তারপর?
তারপর থেকে উজানের সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখিনি।ও যদিও চেষ্টা করেছিল, ফোন ম্যাসেজ, দেখা করতেও চেয়েছিল,কিন্তু আমি’ই আর—
[২]
গড়িয়াহাট ছাড়িয়ে ইরার ট্যাক্সিটা এগিয়ে গেল রাসবিহারী অ্যাভেনিউয়ের দিকে, হাতঘড়িতে তখন ৯-৩২।আজ রাতে ওর শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার কথা ছিলনা কিন্তু মেখলাই বলল ওকে ফিরে আসতে।
“ঘা’কে লুকিয়ে রাখলে সেটা সেরে যায় না বরং প্রকাশ্যে এনে তার চিকিৎসা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।”মেখলার কথা ওর কানে বাজছিল।হ্যাঁ,আর কোনো লুকোছাপা নয়, রজতের কাছে আজই সবকিছু কনফেস করবে ইরা।এরপর যাই ঘটুক না কেন এটলিস্ট নিজের বিবেকের কাছে তো সে পরিষ্কার থাকবে।
ওদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে থামল গাড়িটা।ফ্ল্যাটের আলো জ্বলছে।রজত বাড়িতেই আছে।ইরা’কে হটাৎ দেখে নিশ্চই চমকে যাবে আর তারপর—
আরও একবার ধড়াস করে উঠল ইরার বুকটা। কলিংবেলটা বাজাতে গিয়েও থমকে গেল।তারপর মনের সমস্ত সাহস জড়ো করে চাবি লাগিয়ে নিজেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে এল সে।এগিয়ে গিয়ে বেডরুমের দরজাটা খুলেই স্তব্ধ হয়ে গেল ইরা।
ওর নিজের হাতে সাজানো ঘর,ওর বিছানায় ওরই প্রিয় বেডকভার’টা গায়ে জড়িয়ে রজতের শরীর আঁকড়ে শুয়ে আছে ইরা’র দুঃসম্পর্কের আত্মীয়া ঐন্দ্রিলা।

1 Comment

  1. বেশ ঝরঝরে আর উপভোগ্য লেখনী। ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*