বড়গল্পঃ বিয়ের পণ

বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ঃ

(১)

যেসব পুরুষ মানুষেরা পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে বুক ফুলিয়ে নিজের পৌরুষ জাহির করে, সমীর চৌধুরী তাদের মধ্যে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। সমীর দুই ছেলের জন্মের পরেও এতটা খুশি হয়নি, যতটা মেয়ে নীলার জন্মের পরে হয়েছিল। পাড়াশুদ্ধু সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছিল সমীর। অন্নপ্রাশনও ঘটা করেই করেছিল। নিজের ইনসিওরেন্সের চাকরীর সীমিত আয়ের মধ্যেও চেষ্টা করত ভবিষ্যতের জন্য কিছুটা জমাতে। সবটাই নীলার কথা ভেবে। তার পড়াশুনা ও বিয়ের জন্য।

ছেলে দুজনের কেউই পড়াশুনায় তেমন ভালো হতে পারল না। গ্রাজুয়েশনটাও ঠিক-ঠাক পাশ করতে পারল না। নীলা কিন্তু তার দাদাদের তুলনায় ছিল এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে স্টার পেয়ে নীলা ভর্তি হল বাংলা অনার্স নিয়ে এক নামী কলেজে। মেয়ের বাবা উৎসাহিত হয়ে বলতে লাগল, নীলা তো কোনও সাধারণ মেয়ে নয়, আমার বংশের গৌরব। আমার বংশে ঐ হল জলজ্যান্ত নীলকান্তমণি! কিন্তু এই নীলাকে ঘিরেই সমীরের পুরো পরিবারে এমন এক সমস্যার কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল, যার কথা না বললেই নয়। অবশ্য সে সমস্যা নীলাকে নিয়ে হলেও, তার জন্য নীলা এতটুকু দায়ী নয়। দায়ী তার বাবা সমীর।

(২)

গ্রাজুয়েশনের সময় থেকেই নীলা দুটো-তিনটে টিউশানি আরম্ভ করল। পোস্ট-গ্রাজুয়েশন করবার সময় ব্যাচে ছাত্র-ছাত্রীদের সে বাংলা পড়াত। সমীরের বড় ছেলে ইতিমধ্যেই ভালোবেসে বিয়ে করে ফেলেছে। এখন সামান্য এগরোলের দোকান চালায়। সমীরের চাকরীর রোজগার পড়তির দিকে। আর ছোটছেলেটাও কিছু করেনা। এই সময়ে নীলা ও তার বাবার রোজগার সংসারটাকে টেনেটুনে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে সাহায্য করল।

নীলা যখন ভালোভাবেই বাংলায় এম.এ. শেষ করল, তখন সে মাসের শেষে বাবার হাতে মোটা টাকাই গুঁজে দেয়। নীলার জন্য তার বড় দাদারাও গর্ব অনুভব করে। শুধু বড়ছেলের বউয়ের কেমন যেন ইর্ষা হয়! তার স্বামীর থেকে ননদের রোজগার বেশি। সে চুপিসাড়ে শাশুড়ি মায়ের কান ভারী করে এই বলে, “মা, নীলার বয়স তো কম হল না। এবার ওর একটা বিয়ের ব্যবস্থা করলে হয় না? এমন সুন্দরী, অবিবাহিতা মেয়ে বাড়িতে থাকে, এখানে ওখানে পড়াতে যায়, রাত করে ফেরে। পাড়ার মাতাল ছেলেগুলো সামনের রকেই আড্ডা দেয়। আমার কেমন জানি দুশ্চিন্তা হয়। কোনওদিন কিছু একটা হয়ে গেলে?” শাশুড়ি প্রথমে পাত্তা না দিলেও, পরে সেও বউমার কথা চিন্তা করে। সত্যিই তো, মেয়েটার যে বিয়ে দিতে হবে।

(৩)

সারাজীবন মেয়েকে আইবুড়ো রাখলে যে চলবে না, সে খেয়াল সমীরেরও আছে। স্ত্রীর কথায় সমীর এদিক-ওদিক খোঁজ নেয়। সে চায় নীলার বিয়ে হোক কোনও বনেদী পরিবারে। অনেক খুঁজে-পেতে অন্য শহরের এক বনেদী পরিবারের সন্ধান মেলে। বাবা-মা ও দুই ছেলে। বড় ছেলের জন্য পাত্রীর খোঁজ চলছে। ছোট ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে গেছে। পরিবারটা কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশের নিকটাত্মীয়। পাত্র বিয়ে করেই আমেরিকার সান ফ্রানসিস্কোতে চলে যাবে। সেখানে তার কোম্পানির কী একটা প্রোজেক্ট চলছে। কোম্পানি থেকে পাত্রকে রাজারহাটে ফ্ল্যাটও অফার করেছে। যদিও পাত্র সেই ফ্ল্যাট না নিয়ে বাবা-মায়ের সাথেই থাকে।

সমীর নিজের স্ত্রীকে সম্বন্ধের কথাটা জানায়। স্ত্রী কথাটা পাড়ে মেয়ের কাছে। নীলা কথাটা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। সে বলে, “অসম্ভব। এখনই বিয়ে! সংসারে টাকা আসবে কোথা থেকে আমি যদি চলে যাই? বাবার ওপর খুব চাপ পড়ে যাবে। আমার কলেজের বা ইউনিভার্সিটির বান্ধবীরা কেউই এখন বিয়ে করছে না। তাহলে আমি কেন? তোমরা কি আমায় বোঝা মনে করো?”

মা মেয়েকে বোঝায়, “তেমন কথা নয় মা। সব কিছুরই একটা বয়স আছে। আমি আর তোর বাবা অনেক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একবার বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর বুঝবি তোর মা-বাবা তোর ভালোর জন্যেই কাজটা করেছে। সামনের মাসে ওরা তোকে দেখতে আসবে। তোর বাবা কথা দিয়ে ফেলেছে। তুই আর না করিস না বাপু।”

নীলা বলে ওঠে, “তোমরা কী করে পারলে! আমাকে না জানিয়ে, হঠাৎ…”

(৪)

“পাত্রীর দাদাদের তো দেখছি না?”, প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে পাত্রের বাবা তার সোনালী ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

নিরুপমার বাবা চকিতে উত্তর দিল, “আসলে দুজনেই ব্যবসাপত্তর নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। ছুটির দিনেও তাই রেহাই নেই। হেঁ-হেঁ-হেঁ।”

নীলার বাবা ভাবছিল যে দুই ছেলের অকর্মণ্যতার কথা শুনে এমন সুন্দর সম্বন্ধ যেন ভেস্তে না যায়। বাবার মুখে মিথ্যে কথা শুনে নীলা কঠোর দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু উপস্থিত সকলের সামনে খারাপ দেখাতে পারে ভেবে সে চোখ নামিয়ে নিল। নীলার বাবা কথা ঘুরিয়ে বলল, “আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না দেখছি। রাজভোগ, রসমালাই, সীতাভোগ-মিহিদানা, রাবড়ি, হিংয়ের কচুরী – সবই যে পড়ে রইল।”

পাত্রের বাবার নাম দেবরাজ। দেবরাজবাবু অল্প হেসে বলল, “আসলে আমি সুগার-ফ্রি ডায়েটে আছি।”

“ওহো, তাহলে আপনি অন্তত কিছু খান? বাবা তুমি কিছু খাও?” সমীর ইঙ্গিত করল পাত্রের মা ও এবং স্বয়ং পাত্রের দিকে। দুজনেই হেসে ঘাড় নাড়ল।

পাত্রের নাম শুভ। শুভ একজন ইঞ্জিনিয়ার। বেশ আধুনিকমনস্ক ছেলে। পাত্রী দেখতে আসার ব্যাপারে তাকে আসতে তার বাবা না করেছিল। কিন্তু শুভ বেশ জেদী। পাত্রীকে সে নিজে দেখে পছন্দ করবে। তাই তার আসা চাই। তাকে কিছু খাবার জন্য বলতে শুভ রসিকতা করে বলল, “পাত্রীও অনেকক্ষণ চুপটি করে বসে আছেন দেখছি। তিনি আমাদের সামনে সামান্য মিষ্টি খেলে মন্দ হয় না!”

কথাটা শুনেই নীলার চোখ চলে গেল পাত্রের দিকে। এবং দেখল, একদৃষ্টে পাত্র তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেই দৃষ্টিতে রয়েছে কৌতুকরস, চুম্বকীয় আকর্ষণ, সুখের হাতছানি, দাম্পত্যের বন্ধনের আশ্বাস এবং সর্বোপরি অপরিসীম ভালোবাসার চোরাস্রোত। চারচোখের মিলন ঘটল। নীলা ভাবছিল তার ফর্সা গাল হয়তো বা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে। সে দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে নিল পাত্রের বাবা-মায়ের দিকে।

(৫)

পাত্রের বাড়িতে আজ সমীর, তার স্ত্রী, বড় ছেলের বউমা এসেছে। সমীর সবাইকে বলে দিয়েছে যে কথা-বার্তা বুঝে শুনে বলতে, আচার-ব্যবহারে আভিজাত্য দেখাতে, হ্যাংলার মতো খাবার-দাবার না খেতে, ইত্যাদি। কথা-বার্তা বেশ জমে উঠেছে, এমন সময় দেবরাজবাবু সমীরকে বলল, “চলুন, আপনাকে আমার বাগানখানা দেখিয়ে আনি। আপনার তো আবার ফুলের শখ বলছিলেন না!”

পাত্রের বাবা এমন এমন বিদেশী ফুলের নাম বলতে লাগল, যাদের নাম সমীর জন্মেও শোনেনি। তবু আন্দাজে এমনভাবে মাথা নাড়তে লাগল যেন এসব তার পৈত্রিক বাড়ির ছাদের বাগানেও রয়েছে। এইসব কথার শেষে দেবরাজবাবু একটু গলা খাঁখারি দিয়ে বলল, “সমীরবাবু, আপনার সাথে কিছু বিশেষ, ব্যক্তিগত আলোচনা করবার ছিল। সেটা ঘরে সবার সামনে তো ঠিক হয়না। তাই আপনাকে এখানে ডেকে আনলাম।”

সমীরের ভ্রূযুগল কুঁচকে গেল। কে জানে পাত্রের বাবা কী বলে! সে একটু থতমত খেয়ে বলল, “তা হ্যাঁ, বলুন?”

দেবরাজবাবু হাসল। তারপর বলল, “আসলে আমি ও আমার স্ত্রী বুড়ো হয়েছি। আমাদের আর কতদিনই বা আয়ু বলুন। এইসব বাড়ি-গাড়ি-বাগান-সম্পত্তি – সবই পড়ে থাকবে। এগুলো ভোগ করবে আমার দুই ছেলে আর ছেলেদের বউরা।”

সমীর পাত্রের বাবাকে বাধা দিয়ে বলল, “এসব আপনি কী বলছেন! আপনি ও আপনার স্ত্রী একশো বছর বাঁচবেন। মৃত্যুর কথা মনেও আনবেন না।”

দেবরাজবাবু বলল, “তবু… একদিন তো যেতেই হবে। আর আমরা চলে গেলে সম্পত্তির ভাগ আমাদের পুত্রবধুও পাবে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে আপনার মেয়ে নীলা বিশাল ধন-সম্পত্তি-প্রতিপত্তি লাভ করতে চলেছে। এবার একটা কথা বলি আপনাকে। কিছু পেতে গেলে কিন্তু কিছু দিতেও হয়। সুতরাং…”

সমীরের মুখটা যেন কালো হয়ে গেল। এমনটা তো সে আশা করেনি। সে ঢোঁক গিলে বলল, “ইয়ে, মানে, বাড়ির একমাত্র মেয়েকে যখন আপনার কাছে পাঠাব, তখন সাজিয়ে গুছিয়েই পাঠাব।”

দেবরাজবাবু তাচ্ছিল্যভরে সমীরকে হাত তুলে থামিয়ে দিল। তারপর বলল, “আহাহা, ঐসব গয়নাগাটি-শাড়ি-তত্ত্বর কথা কে বলছে! ওসব তো যা দেবেন, দেবেন। আমি বলছি ক্যাশের কথা। আমার কিন্তু এক কোটি চাই। তবেই কথা এগোবে। কেমন?”

নিজেকে সমীরের পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর মতো মনে হচ্ছিল। কোনওরকমে ঘাড় নাড়ল সে।

(৬)

“কী হল শোবে না?” সমীরের স্ত্রী জিজ্ঞেস করে সমীরকে। সমীর উত্তর দেয় না। হলঘরে আলো জ্বালিয়ে চুপটি করে বসে থাকে।

স্ত্রী কাছে এসে বলে, “কিসের এত চিন্তা করছ বল তো? চল, শোবে চল।”

সমীর বলে, “নীলার বিয়ে নিয়ে চিন্তা করছি। অনেক টাকা লাগবে গো, অনেক টাকা…”

স্ত্রী সরলভাবে বলল, “অফিস থেকে রিটায়ার করার পরে যে টাকাগুলো পেলে ওতেই হয়ে যাবে। আর গয়না নিয়ে অত ভেব না। আমার বিয়ের সোনার হার আর চুড়িগুলো তো পড়েই আছে। ওগুলো মেয়ের বিয়ের জন্যই তো তুলে রাখা…”

সমীর এক কোটি টাকার কথাটা আর স্ত্রীকে খুলে বলল না। সংক্ষেপে শুধু বলল, “চল, শুতে চল।” বিছানার শুয়ে থাকে সমীর। টাকার চিন্তায় তার ঘুম আসে না।

পরের দিন দু-তিন জায়গায় ফোন করে সমীর। তার বেশ কিছু পুরনো বন্ধুকে টাকার সমস্যার কথা জানায়। এক ইনসিওরন্সের পুরনো ক্লায়েন্টের সাথেও কথা বলে সে। কিছু কিছু মানুষ তাকে লাখ খানেক করে টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু তাতে যে কোটি টাকার হিসেব আসছে না। বিপন্ন হয়ে সমীর শেষে পাত্রের বাবাকেই ফোন করে।

দেবরাজবাবু সব শুনে ফোনের ওপাশ থেকে অট্টহাসি করে ওঠে। তারপর বলে, “যার ছেলেরা বড় ব্যবসায়ী তার আবার কোটি টাকার চিন্তা! শুনুন, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে আপনার ছেলেরা তো কিছুই করেনা মশাই। বামুন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার ইচ্ছে ছাড়ুন। আমি এই বিয়ের প্রস্তাবে আর রাজি নই। ঠগীদের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের সম্বন্ধ হয় না। বুঝলেন?”

নীলার বাবা এই অপমানটাও হজম করে নেয়। কাতর কণ্ঠে বলে, “দোহাই আপনার, পাড়া-প্রতিবেশী-আত্মীয় সবাইকেই আপনাদের সাথে সম্পন্ধের কথা জানিয়ে দিয়েছি। এমনভাবে না করবেন না। আজ পর্যন্ত যত টাকা উঠেছে, তা আমি কালকেই গিয়ে হাতে হাতে দিয়ে আসব। আর বাকি টাকাটা বিয়ের পরে পরেই দিয়ে দেব।”

পাত্রের বাবা ফোন কেটে দেয়। হতবুদ্ধি হয়ে মেয়ের বাবা বসে থাকে।

(৭)

দশ দিন পরে হঠাৎ পাত্রের বাবার ফোন আসে। গলার স্বর গম্ভীর হলেও কিছুটা নরম। পাত্রের বাবা বলে, “শুনুন মশাই, আপনার-আমার যুগ একরকম ছিল। এখনকার যুগ অন্যরকম। আমার ছেলে কী করে যেন আপনার মেয়ের সাথে স্যোশাল মিডিয়ায় বন্ধুত্ব করে নিয়েছে। সেখানে তাদের নাকি রোজই কথা হয়। তো, কথা হচ্ছে যে ছেলে আমার নাছোড়বান্দা। আমি বা আমার স্ত্রীর শিক্ষাদীক্ষার মূল্য তার কাছে নেই। সে ঐ আপনার মেয়েকেই বিয়ে করতে চায়। আমি তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করব বললেও তার আপত্তি নেই! সুতরাং শেষ পর্যন্ত তার মতকেই মেনে নিতে হয়েছে। তাহলে বাকি রইল ঐ এক কোটি টাকাটার ব্যাপারটা…”

নীলার বাবার ধড়ে যেন প্রাণ আসে। আবেগের আতিশয্যে সমীর বলে ওঠে, “হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ, ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। চল্লিশ লাখ টাকার কাছাকাছি উঠেছে। বা-বা-বাকি টাকাও ঠিক উঠে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি। যা টাকা হাতে এসেছে, সেসব নিয়ে তাহলে এই রবিবার আসি?”

দেবরাজবাবু কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বলল, “আসুন। তবে সব টাকা ক্যাশে নিয়ে আসবেন কিন্তু।”

নিরুপমার বাবা তার রিটায়ারমেন্টের যাবতীয় টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তোলে। অন্যদের থেকে ধার করা টাকাও জড়ো করে। সব টাকা সাবধানে একটা ব্রিফকেসে রাখে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সমীর সাবধানে ব্রিফকেস খোলে। মোমবাতির আলোয় দেখে কত টাকা জমল। শনিবার রাত পর্যন্ত চেয়ে চিন্তেও সব মিলিয়ে সমীর দেখে যে বত্রিশ লাখ উঠেছে, যা চল্লিশ লাখের থেকে অনেক কম। “এহ, কথার খেলাপ হয়ে গেল। পাত্রের বাবা কী ভাববে!” সমীর নিজের মনেই বলে ওঠে।

পরের দিন সমীর ব্রিফকেস নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে। বাড়িতে বলে যায় যে এক পুরনো ক্লায়েন্টের সাথে কিছু শলা-পরামর্শ আছে। রবিবার সকাল বলে পাত্রের বাড়ির কাউকেই সে বসার ঘরে দেখতে পায় না। একজন চাকর “বসুন” বলে সেই যে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায়, সে আর বেরোয় না।

প্রায় এক ঘণ্টা পরে পাত্রের বাবা আসে। তার পেছন পেছন সেই চাকর আসে দু’কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে। দেবরাজবাবু কিছুটা আগ বাড়িয়ে গর্বের সাথে বলে, “আমার ছেলে শুভ গেছে সান ফ্রানসিস্কো। ওদের অফিস থেকেই পাঠিয়েছে। তাই ভাবলাম যে এই সময়েই টাকার ব্যাপারটা মিটিয়ে নিই।”

এবার পাত্রের বাবার নজর গেল ব্রিফকেসের দিকে। পাত্রের বাবা জিজ্ঞেস করল, “ক্যাশ নিয়ে এসেছেন তো? কত আছে? চল্লিশ?”

সমীর কাঁপা-কাঁপা হাতে ব্রিফকেস এগিয়ে দিয়ে বলল, “না, বত্রিশ।” আর তার সাথে যোগ করে, “এই স্ট্যাম্প পেপারে একটা সই করে দেবেন।”

দেবরাজবাবু বলল, “সই? কিসের সই?”

সমীর নিচু গলায় বলল, “এই যে আপনি বত্রিশ লাখ টাকা নিলেন, তার জন্য…”

পাত্রের বাবা হেসে উঠে বলল, “হাসালেন মশাই, পণের টাকার আবার সই-সাবুদ হয় নাকি? তবু দাঁড়ান, চাইছেন যখন, তখন একবার গিন্নির সাথে পরামর্শ করে আসি। পাঁচ মিনিট বসুন, আসছি।” এই বলে পাত্রের বাবা স্যুটকেস ও স্ট্যাম্প পেপার নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে যায়।

পাত্রের বাবা আর ফেরে না। সমীর চাকরকে বার-বার জিজ্ঞেস করে। চাকর বাঁকা হাসি হেসে জানতে চায়, “আপনি কী জন্য এত চিন্তা করছেন?”

সমীর চিৎকার করে ওঠে, “উনি আমার থেকে এতগুলো টাকা নিলেন ব্রিফকেসে করে। তার সই-সাবুদ থাকবে না?”

বাড়ির চাকর নরম গলায় বলল, “ব্রিফকেস? কই আমি তো কোনও ব্রিফকেস দেখলাম না?” তারপর হাঁক দিল, “যাকগে…হরি, এই হরি? একবার আয় তো এদিকে।”

দ্বিতীয় চাকর বাইরে এল। তার হাতে শক্ত করে ধরা দুটো ডোবারম্যানের গলার চেন। কুকুরদুটো সমীরকে দেখেই বিপুলভাবে চিৎকার করতে লাগল। এবার প্রথম চাকর কঠিন গলায় বলল, “এইবেলা বিদেয় হোন। নইলে আমরা কিন্তু ডোবারম্যানদুটোকে আপনার ওপর ছেড়ে দেব। আপনার গলার নলি ছিঁড়ে খাবে। বুঝলেন দাদু?”

(৮)

“এখন উনি কেমন আছেন ডাক্তার?” উদগ্রীব কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সমীরের স্ত্রী।

“আগের থেকে ভালো। সেরে উঠতে কয়েকদিন সময় লাগবে।” ডাক্তারের উত্তর।

নিরুপমা জিজ্ঞেস করল, “বাবার ঠিক কী কী সমস্যা হয়েছে ডাক্তারবাবু?”

ডাক্তার বলল, “পড়ে গিয়ে ঘাড়ে-মাথায় আঘাত লেগেছে। এছাড়া প্রেশারও ফল করে গিয়েছিল।”

নিরুপমা বলল, “বাড়িতে ঢোকা থেকেই মনে হচ্ছিল বাবার শরীরে যেন কোনও শক্তি নেই। আমাদের ভাগ্য ভালো যে বাড়ির ভেতরেই দোতলার সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে বাবা। তাড়াতাড়ি আপনাদের কাছে আনতে পেরেছি। রাস্তায় ঘটনাটা ঘটলে তো…”

ডাক্তার আশ্বাস দিয়ে বলল, “যাইহোক, আমরা চেষ্টা করছি ওনাকে সুস্থ করবার।”

একের পর এক দিন কেটে যায় নীলার পরিবারের উৎকণ্ঠায়। সমীরের শরীরের আঘাত সেরে আসে, কিন্তু তার মনের আঘাত সারতে চায় না। সে চোখ বন্ধ করে দেখতে পায় শুভর বাবা তার ব্রিফকেসটা নিয়ে চলে যাচ্ছে। সে মনে করে কেমন করে তাদের বাড়ির সামান্য চাকর তাকে ধাক্কা মেরে গেটের বাইরে বের করে দিয়েছিল। কী অপমান! জীবনে এই দিনও দেখবার ছিল। সমীরের ইচ্ছে হচ্ছিল যে মেয়েকে সব কিছু খুলে বলে। নীলাকে সব খুলে বলতে তার ভয় হয়। রাগের মাথায় কী করে বসে! এক সপ্তাহ পরে সমীর বাড়ি আসে। রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সমস্ত ঘটনা বলে। স্বামীর অপমানের কথা শুনে এবং তাদের বুড়ো বয়সের আর্থিক সম্বলটুকু হাতছাড়া হয়ে গেছে শুনে স্ত্রী কপাল চাপড়াতে থাকে। বুড়ো-বুড়ি নিঃশব্দে কেঁদে চলে। রাতের অন্ধকার শুষে নিতে চায় তাদের সবটুকু কান্না, কিন্তু পারেনা।

সমীর বারণ করেছিল নীলাকে কিছু জানাতে। কিন্তু তার স্ত্রী কথাগুলো চেপে রাখতে পারেনা। সকাল হতেই নীলাকে সব বলে জানায়। ক্রোধের রোষানল আছড়ে পড়ে নীলার মুখে। নীলা তৎক্ষণাৎ পুলিশে খবর দিতে চায়। কিন্তু তার বাবা তাকে বুঝিয়ে কোনওরকমে তখনকার মতো নিরস্ত করে। নীলা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি কি কোনও অকেজো জড়বস্তু যে এতগুলো টাকা ঘুষ দিয়ে আমাকে ঐ পিশাচগুলোর পরিবারে বিক্রি করে দিচ্ছ!”

সমীর আহত গলায় বলে, “তা নয় মা। তুই হলি আমার বুকের ধন। আমার নীলকান্তমণি। অন্যকে ঘুষ দিতে যাব কেন? আসলে তোকে ঘিরে আমার যে অনেক স্বপ্ন মা। ইচ্ছে ছিল বনেদী পরিবারে তোর বিয়ে দেব। রাজরাণী হবি তুই।”

নীলা চিৎকার করে বলল, “বাবা, রাখ তোমার বনেদী পরিবার। মেয়েদের যারা বস্তু বলে ভাবে, যারা দিন-দুপুরে মানুষের সততার সঞ্চয় লুঠ করে, তাদের পরিবারে কাজের লোক হয়েও তোমার মেয়ে থাকতে চায় না।”

নীলা ও সমীর দুজনেই উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছিল। সামান্য ধাতস্থ হলে নীলা নিচুস্বরে বলল, “শুভ এখন ভারতের বাইরে। আমি ওকে ফেসবুকে সব জানাচ্ছি। ও ফিরছে পরশু। আমি ওর সাথে সামনা-সামনি কথা বলে জানতে চাইব যে ও নিজের বাবার মতোই জানোয়ার কিনা। যদি টাকা ফেরত দেয় তো ভালো। নইলে আমি থানা-পুলিশ করতে বাধ্য হব। দোহাই আমাকে তোমরা বাধা দিও না।”

(৯)

ঘরে নীলার পুরো পরিবার বসে আছে। শুভ একা দাঁড়িয়ে। নীলা কঠোর দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকিয়ে আছে। শুভই প্রথমে মুখ খুলল। সমীরের দিকে তাকিয়ে শুভ বলতে শুরু করল, “কাকু, কিছু ভুল ধারণা আপনার প্রথম থেকেই আমাদের পরিবারের সম্পর্কে হয়েছে। যেমন আপনি মনে করেছেন আমরা বিশাল সম্পত্তির মালিক। কিন্তু তা আংশিক সত্য। যে বাড়ি-ঘর আপনি দেখে এসেছেন, তার মালিকানা নিয়ে কাকাদের সাথে আমাদের গত তিন বছর ধরে কোর্টে কেস চলছে। এই কেসে যদি হেরে যাই, তাহলে বাড়ি-গাড়ি-সম্পত্তি সবকিছুই ভাগ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যে আমার বাবা যে ব্যবসা দেখে, তা গত একবছর ধরেই লসে রান করছে। আমার বিয়ে দেওয়ার নাম করে বাবা অন্যায়ভাবে কাঁচা টাকা লোকের কাছ থেকে নেওয়ার তালে ছিল। আপনার কাছ থেকে যে টাকা চাওয়া হয়েছে এবং নেওয়া হয়েছে, তা সমস্ত কিছুই আমাকে না জানিয়ে করা হয়েছে। ব্যাপারটা জানতে পারলে আমি এটা হতেই দিতাম না। নিজের বাবাকে বাবা বলে ডাকতেও আমার লজ্জা হচ্ছে। আরও বলি, আপনার সাথে আমার বাড়িতে যে অমানবিক আচরণ হয়েছে, তার পরে আমি ও বাড়িতে আর ঢুকবোই না। রাজারহাটে একটা নতুন ফ্ল্যাট আমায় অফিস থেকে দেওয়াই হয়েছিল। এবার থেকে আমি সেখানেই থাকব। এবং পুরো ঘটনার জন্য আমি আমার পরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইছি।”

নীলার রাগ এতটুকু কমেনি। সে ঝাঁঝাঁল গলায় বলল, “শুধু ক্ষমা নয়, আমাদের বত্রিশ লাখ ফেরত চাই।”

শুভ একটু কষ্ট করে হাসল। তারপর বলল, “আমি জানতাম যে নীলা বা আপনাদের কেউ এই কথা তুলবেন। টাকার ঋণ আমি আস্তে আস্তে শোধ করে দেব।”

এই বলে শুভ নিজের পকেট থেকে একটা চেক বের করল। সমীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে সে বলল, “এটা চোদ্দ লাখ টাকার চেক। আমার চাকরী থেকে রোজগার করা টাকা। বাকি টাকাটাও আমি যেভাবে হোক ঠিক দিয়ে দেব। তবে আমার একটা বিশেষ অনুরোধ আছে কাকু।”

সমীর শরীরটাকে সামান্য ঝুঁকিয়ে চেকটা হাতে নিল। তারপর শান্ত গলায় বলল, “বল।”

শুভ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “আমি নীলাকে বিয়ে করতে চাই। আশা করি আপনি আপত্তি করবেন না।”

সমীর কিছু বলবার আগেই নীলা ঘরভর্তি সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলল, “এত কিছু ঘটে যাবার পরেও আপনি বিয়ে নিয়ে ভাবছেন? আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না। আপনি আমাদের টাকা আমাদেরই ফেরত দেবেন বলে আপনাকে বিয়ে করতে হবে?”

শুভ মুখ নামিয়ে বলে, “টাকা ফেরত দিচ্ছি বলে তো বিয়ের কথা বলিনি। আপনাকে মন থেকে ভালোবাসি, তাই বলেছি। আমি আসলে দেনা-পাওনায় ঠিক বিশ্বাস করি না।”

শুভর গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে কেউই কোনও কথা বলে উঠতে পারল না। নীলাও না। ঘরে নেমে এল কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। সবাই যেন কিছু একটা ভাবছে। শেষ পর্যন্ত সমীর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল। খানিকটা কথা ঘোরানোর জন্য নিজের দুই ছেলেকে ধমক দিয়ে বলল, “তোরা কি এমন করেই বসে থাকবি? শুভ বিদেশ থেকে ফিরে সোজা এবাড়িতে এসেছে, তাকে তো একটু মিষ্টিমুখ করাতে হয় না কী! যা-যা, তাড়াতাড়ি দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে আয়।”

ছেলেরা গেল মিষ্টি আনতে। সমীরের স্ত্রী দ্রুতপায়ে চলে গেল হেঁসেলে। সমীর তার মাথা ব্যথা দেখিয়ে উঠে পড়ল। ঘরে কেবল শুভ ও নীলা।

শুভ এগিয়ে গেল নীলার কাছে। সবার সামনে আপনি করে কথা বলছিল। এবার আপনি থেকে আবার তুমিতে নেমে এল। শুভ বলল, “আমার ওপর রাগ করে আছ?”

নীলা উত্তর দেয় না। কিন্তু তার মুখ দেখলেই বোঝা যায় যে তার রাগ পড়ে এসেছে। শুভ নীলার থুতনিটা আলতো করে তুলে ধরে বলে, “আমার ভালোবাসার ওপর একটুও বিশ্বাস নেই তোমার? বল?”

নীলা উত্তর দেয় না। তার ঠোঁটের কোণে সলজ্জ হাসির রেখা দেখা দেয়। যেন নীলকান্তমণির বিভা। সেই আলোকচ্ছটায় শুভর মুখও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*