তোমারে সেলাম

ভাস্কর ঘোষাল

আমরা অনেক সময় বিশিষ্ট ব্যক্তি সম্বন্ধে বলতে বা লিখতে গিয়ে কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করে থাকি। ‘ মাইলস্টোন ‘, ‘ প্রতিষ্ঠান ‘ ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব শব্দবন্ধ প্রয়োগের মাধ্যমে সহজে দায় সেরে ফেলতে ভালোবাসি। চালাকির দ্বারা কোনও ভালো কাজ করা যায় না —- এই বহু চর্চিত কথা আমরা ভুল যাই। মাঝে মধ্যে বিশেষ বিশেষ ব্যাক্তি তা মনে করিয়ে দেন। রাজ কাপুর তেমনই এক ব্যাক্তিত্ব। পাঁচ ও ছয়ের দশকে বম্বের (এখন মুম্বই) অনেক সিনেমা নির্মাতা নিজেদের সবার সেরা বলে ভাবতেন। তবে একটা পূর্বশর্ত সহ— রাজ কাপুরের পরে যাঁরা, শুধু তাঁদের মধ্যে। এমনটি জানিয়েছেন বানি রিউবেন তাঁর লেখা রাজ কাপুরের জীবনীতে।

একদিকে তাঁর সিনেমার বিষয়-বৈচিত্র, অন্য দিকে তাঁর লোকেশন— বম্বে থেকে মহাবালেশ্বর, চম্বল থেকে আল্পস হয়ে কাশ্মীর— সব কিছুতেই মুন্সিয়ানার ছাপ। অভিনয় ছিল তাঁর সহজাত। তাঁকে শুধু একজন অভিনেতা হিসেবে বর্ণনা করলে ভুল হবে। সিনেমা শিল্পের সবকটি বিভাগে তাঁর চলাচল ছিল খুবই স্বাভাবিক কিন্তু স্বতন্ত্র। নির্দিষ্ট এক বা দুই রাস্তা দিয়ে তাঁর হাঁটতে ভালো লাগত না। চেনা ছক ভাঙতেই তাঁর ছিল আনন্দ। সিনেমায় অভিনয় শুরুর অল্প দিনের মধ্যেই নিজেকে নির্মাতার ভূমিকায় দেখতে চেয়েছিলেন রাজ কাপুর। এই কাজেও তিনি সফল হয়েছিলেন সমান ভাবে। 

ভারতীয় সিনেমা জগতের সমান্তরাল ধারার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন খোয়াজা আহমেদ আব্বাস৷ রাজ কাপুর প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে যাঁর কথা চলে আসে স্বাভাবিক নিয়মে।রাজ কাপুরের একাধিক সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনি৷ এর মধ্যে ‘জাগতে রহো’ ছাড়াও রয়েছে ‘আওয়ারা’, ‘শ্রী ৪২০’, ‘মেরা নাম জোকার’, ‘ববি’৷ তাঁর লেখা সংলাপ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সেই সময়।

রাজ কাপুরের সিনেমা মানেই মিউজিক। সুরের দোলার মতন এগিয়ে যেত তাঁর সিনেমা। গানকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন। শুধু গানের মধ্য দিয়ে কিভাবে একটা সিনেমা দর্শক মন ধরে রাখতে পারে তা তিনি নিজে সিনেমা তৈরি করে দেখিয়ে গিয়েছেন। সুরের পাশাপাশি গানের কথাও ছিল তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আইপিটিএ – তে একজন কবিতা পড়ছিলেন। তাঁর লেখা পছন্দ হওয়ায় ‘ আগ ‘ সিনেমায় গান লেখার জন্য অনুরোধ করলেন। বামপন্থী বিচার ধারায় আঘাত লাগার কারণে রাজ কাপুরকে প্রত্যাখ্যান করলেন তাঁরই সমবয়স্ক সেই ছেলে।

কিছুূদিন পরে অভাবের ফেরে তাঁকেই রাজ কাপুরের কাছে আসতে হয়, ৫০০ টাকা ধার করতে, পরে ফেরত দিতে গেলে রাজ কাপুর বলেন, টাকা নয় ‘বরসাত’ এর দুটো গান বাকি আছে, ও দুটো লিখে দিতে। তিনি লিখলেন, বরসাত মে হমসে মিলে তুম। ভারতীয় সিনেমার প্রথম টাইটেল মিউজিক এই গানটা। সেদিনের সেই ছেলের নাম শঙ্করদাস কেসরিলাল। শৈলেন্দ্র নামে যিনি রাজ করেছেন পরবর্তী সময়ে। ১৯৪৯ থেকে রাজ কাপুরের টিমে জুড়ে গেলেন।

এরপর একের পর এক আওয়ারা, জংলি, আনাড়ি, জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়, দিল অপনা অউর প্রীত পরায়া, শুধু সিনেমাতে গান লেখাই নয়, এই সব সিনেমার টাইটেল মিউজিক লেখা ওঁর। সোজা ভাষায় কবিতা লিখতেন তিনি। ওঁর সম্পর্কে গুলজার একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সমস্ত গীতিকারদের মধ্যে একমাত্র শৈলেন্দ্র, নৈপুণ্য আর সফলতার সঙ্গে সিনেমায় জুড়তে পেরেছিলেন। বাকিরা কবি থেকে গেলেন, যারা সিনেমার জন্যে গান লিখেছেন। সিনেমার চরিত্র যদি বিহারী হয়, ভোজপুরি ভাষায় গান পাবেন ওঁর লেখায়, চরিত্র যদি মধ্যবিত্ত হয়, সেই ভাষায় গান পাবেন, চরিত্র যদি স্পষ্ট উর্দু ভাষী বা হিন্দিভাষী হয়, সেই লেখাও পাবেন।
রাজ কাপুর সব সময় প্রতিভার সন্ধানে থাকতেন। অভিনয় থেকে শুরু করে সুর করার দায়িত্ব তিনি অনায়াসে ছেড়ে দিতেন নতুন কোনও শিল্পীর হাতে। এমনই আরও এক তাঁর আবিষ্কার শঙ্কর– জয়কিসেন। 

শিল্প সৃষ্টিতে সাবেকি রীতির বিরোধী ছিলেন তিনি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঝুঁকি নিতে ভয় পাননি কখনও। ‘বরসাত’-এর জন্য তিনি শঙ্কর- জয়কিষেনকে বেছে নিলেন, সেই সময় পৃথ্বী থিয়েটারের একমেবাদ্বিতীয়ম সঙ্গীতকার রাম গাঙ্গুলি। বিভিন্ন মহলের পাশাপাশি প্রতিবাদ জানান পৃথ্বীরাজ নিজেও। কিন্তু তাঁকে দমানো যায়নি। রিলিজের পর দেখা গেল  ‘বরসাত’ ডায়মন্ড জুবিলি হিট।  পাঁচের দশকে সেই সিনেমাই এই কৃতিত্বের প্রথম অধিকারী। শঙ্কর-জয়কিষেন যে ভাবে লোকগান এবং মূলত ভৈরবী-আশ্রিত সুর ব্যবহার করে ছিলেন , তা একেবারে অন্য রকমের।

‘বরসাত’ই মনে হয় প্রথম হিন্দি সিনেমা, যেখানে নেপথ্যসঙ্গীতের একটা টুকরো পুরো ছবিটির লেইটমোটিফ হয়ে ওঠে।  শোনা যায় রাজ কাপুর ইয়ন ইভানোভিচি-র ‘ওয়েভস অফ দান্যুব’-এর স্বত্ব কিনে নিয়েছিলেন। বেহালায় সেই সুরট বাজাচ্ছেন রাজ কাপুর— সিনেমার ফ্রেমটি ইতিহাসে এখনও পাকাপাকি ভাবে রয়েগিয়েছে। পাশাপাশি যন্ত্রানুষঙ্গেরও পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন রাজ কাপুর। বেহালা ছেড়ে ‘আওয়ারা’-তে বেছে নিলেন আরও ট্রেন্ডি পিয়ানো-অ্যাকর্ডিয়ন। হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে সব থেকে পরিচিত কাউন্টার-মেলডি/ফিলারটি বাজিয়েছিলেন ভি বালসারা। হারমোনিয়াম থেকে বের করেছিলেন অ্যাকর্ডিয়নের আওয়াজ। পরে এই অ্যাকর্ডিয়নই রাজ কাপুরের সঙ্গে সমার্থক হয়ে ওঠে। সহজেই স্মৃতিতে ভেসে আসে ‘সঙ্গম’,  ‘ মেরা নাম জোকার ‘ – এ অ্যাকর্ডিয়ন হাতে রাজ কাপুরের ছবি। 

‘আওয়ারা’  আর এক দিক থেকেও অনন্য, তাতে কষ্ট ও আনন্দের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল ফিউশন। ‘তেরে বিনা আগ ইয়ে চাঁদনি’ এবং ‘ঘর আয়া মেরা পরদেসি’— এই দু’টি গান দিয়ে গড়ে তোলা হয় স্বপ্নদৃশ্যের দু’টি ভাগ— প্রথমে নরক থেকে স্বর্গের দিকে প্রতীকী যাত্রা, এবং শেষে বাস্তবে প্রত্যাবর্তন। এরপরই ‘আহ’- র শান্ত আবহ। বক্স-অফিসে তেমন সাড়া না জাগাতে পারলেও তার সঙ্গীত চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। আবার, ‘আহ্’-র সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর সিনেমা  ‘শ্রী ৪২০’।  এই ফিল্মে ‘মুড় মুড় কে না দেখ’-এর তালের প্যাটার্ন কী ভাবে পাল্টায়, তা লক্ষণীয়। আর বিখ্যাত গান  ‘পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া’-এর মধ্যে ঢোলকের বিশেষ ধরনের কাজ শোনা যায়। যা পরবর্তী কালে ‘ দাত্তু ঠেকা ‘ নামে বিখ্যাত। সেসময় শঙ্কর-জয়কিষেনের সহকারী ছিলেন দত্তারাম ওয়াদকর। তাঁর নামানুসারে এই ছন্দ সঙ্গীত অনুরাগীদের মাঝে পরিচিত হয়।

রাজ কাপুর-এর এই তাল-এর প্রতি প্রেম  ‘জিস দেশ মেঁ গঙ্গা বেহতি হ্যায়’-তে আরও স্পষ্ট। তবে সুর কখনও অবহেলিত হয়নি। এই ফিল্ম-এরই ‘ও বাসন্তী পবন পাগল’ নিঃসন্দেহে সেই দশকের সেরা সুরের অন্যতম। অনেক সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরই পরে অন্য কোনও সিনেমায় স্বয়ংসম্পূর্ণ গান হয়ে ওঠে।   ‘মেরা নাম জোকার’-এ ‘জানে কঁহা গয়ে ওয়হ দিন’ গানের সুর  ‘আহ’-তে শোনা যায়। রাজ কাপুর-এর চলচ্চিত্রের শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরই আলাদা করে শোনা উচিত। ‘সঙ্গম’ এবং ‘মেরা নাম জোকার’ শুধু অবিস্মরণীয় সুরই নয়, নিখুঁত ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর-এর জন্যও সমান খ্যাত। 

প্রথমে জয়কিষেন এবং পরে মুকেশের মৃত্যুদিশেহারা করে তোলে রাজ কাপুরকে। সঙ্গীত নিয়ে শলা-পরামর্শের দুই সঙ্গীকে হারিয়ে কেমন যেন সুর কেটে যায় তাঁর জীবনেও। সেসময় একমাত্র ‘ ববি ‘  ছাড়া তাঁর কোনও ফিল্মেই এমন কোনও গান শোনা যায়নি যা সময়ের থেকে এগিয়ে ছিল। তাঁর আগের সিনেমা বলিউডের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যা আজও সমান ভাবে বর্তমান।  ভারতীয় হিন্দি সিনেমা বিদেশের বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে তাঁর হাত ধরে। বলিউডও যে একদিন হলিউডের সমকক্ষ হতে পারে —- কলাকুশলীদের মধ্যে চিন্তার বীজ বপন করেছিলেন রাজ কাপুর।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*