শিল্পীর দায়বোধ ও জয়নুল আবেদিন

তপন মল্লিক চৌধুরী

ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ঔপনিবেশিক শাসক তার শাসন-শোষণ দৃঢ় করতে যে সব পদ্ধতি বা কৌশল নিয়ে চলত তার মধ্যে কেন্দ্র ও প্রান্তের ধারনা ছিল অন্যতম । ব্রিটেন কেন্দ্র আর ভারত প্রান্ত একইভাবে বাংলার প্রেক্ষিতে কলকাতা কেন্দ্র আর অন্যান্য অংশ প্রান্ত এই ধারনায় বিশ্বাসী ছিল অধিকাংশ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি । তবে ব্যতিক্রমী ছিলেন অনেকেই তাঁদের মধ্যে অবশ্যই করতে হয় জয়নুল আবেদিনের নাম । প্রান্ত বা গ্রামবাংলাকে ভুলে নাগরিক মন-মানসিকতায় আচ্ছন্ন হতে পারেন নি জয়নুল । সুদূর ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কলকাতা এসে ছবি আঁকার পাঠ নিলেও তাঁর নিজের শিল্প-বিষয় ও ভাষা নির্মাণে আজীবন জড়িয়েছিলেন প্রান্ত ও প্রান্তবাসীর জীবনবোধে, কখনোই আকৃষ্ট হননি নাগরিক আভিজাত্যে ।জন্মভূমি ময়মনসিংহের জনজীবন ও প্রকৃতির প্রতি, অসচ্ছল বৃহত্তর পারিবারিক পরিবেশের প্রতি তিনি ছিলেন আত্মিকভাবে ঘনিষ্ঠ ও শ্রদ্ধাশীল । প্রসঙ্গত কলকাতা আর্ট স্কুলে অধ্যক্ষ মুকুল দের পরামর্শ স্বত্বেও ইন্ডিয়ান আর্ট বিভাগে ভরতি না হয়ে পাশ্চাত্যের অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করেও বরাবরই সংলগ্ন ছিলেন ময়মনসিংহের স্থানিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি । এক্ষেত্রে সবসময়েই তিনি এড়িয়ে গেছেন শহুরে বা নগরকেন্দ্রিক মানসিকতা । এ বঙ্গের শিক্ষিত বাঙালি কিন্তু তাঁর বিষয়ে একরকম বিস্মৃতই বলা যায় । কেবল তাই নয় চিত্রশিল্পী, ভাস্কর তাঁরাও কি কখনো জয়নুল আবেদিনের অবদান সেভাবে স্মরণ করেছেন ? ২০১৪ সালে শিল্পীর জন্ম শতবর্ষেও মনে পড়ে না এই বঙ্গের কোথাও শিল্পী জয়নুল আবেদিনকে কেউ কোনও ভাবে মনে করেছেন ।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে গ্রাম থেকে অনাহারক্লিষ্ট কাতারে কাতারে মানুষ আসে কলকাতায় । সেই সব দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের ভাত আর ফ্যানের জন্য আর্তনাদ জয়নুলের অন্তরে হাহাকার করেছিল । শিল্পী মন একদিকে যেমন বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাসহ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নিষ্ঠুর পরিণতির কথা উপলব্ধি করলেন, অন্যদিকে মৃত্যুতাড়িত মানুষগুলির জন্যও অনুভব করলেন গভীর ঐকান্তিকতা । এরপরই সেই ভয়ংকর বাস্তব ফুটে উঠল তাঁর আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবিতে—মর্মান্তিক এবং চূড়ান্ত নিষ্ঠুর সেই সব দৃশ্য যেমন একদিকে শিল্পভাষায় অন্য এক মাত্রা যোগ করল পাশাপাশি দুরভিক্ষের ভয়াবহতাকেও বুঝিয়ে দিলো চোখে আঙুল দিয়ে । কলকাতার রাজপথের ঘটনাকেই তিনি তাঁর ছবিতে তুলে ধরেছেন, কিন্তু ওই মানুষগুলি কোনোভাবেই নগরকেন্দ্রিক সুবিধাভোগী শ্রেণির পর্যায়ভূক্ত নয়, ক্ষুদার তাড়নায় তারা গ্রাম থেকে এসেছেন মাত্র তবে সাময়িকভাবেই । আসলে কালো কালির রেখায় যেসব অনাহারক্লিষ্ট চেহাড়া আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা তিনি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তা জীবনবোধ এবং মানুষের প্রতি দায়বোধ ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয় । শিল্পী জয়নুলের চেতনা বা ঐকান্তিকতাই দুরভিক্ষ-চিত্রমালার আসল গুরুত্ব এবং তাৎপর্য ।

মন্বন্তর-এর ছবির মধ্য দিয়েই জয়নুল হাজির হন নতুন এক বাস্তবতার এবং নতুন এক পরিস্থিতির । অনিবার্য প্রক্রিয়ায় তিনি সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন দেশের প্রগতিবাদী সাহিত্যিক-শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সমষ্টিগত ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে ।এরপর তিনি ঊপলব্ধি করেন যে আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক চেতনার দীনতা এবং সংকটই এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্যতম অন্তরায় । শিল্পীর ব্যক্তিবিচ্ছিন্ন শিল্পচর্চা ওই সংকট বা অন্তরায় ঘোচাতে যথেষ্ট নয় । এক্ষেত্রে সমষ্টিগত ভাবনা যৌথভাবে শিল্পচর্চা ইত্যাদি খুবই প্রাসঙ্গিক এবং বহুসময়েই তা অপরিহার্য ও কার্যকরী মীমাংসা ।স্বাধীনতা উত্তরকালে তার এই সমষ্টিগত চিন্তা আরও দৃঢ় হয় এবং মূখ্য হয়ে ওঠে ।

দেশভাগ হওয়ার পর তিনি তাঁর জন্মস্থানের কারনেই পূর্ববাংলাকেই বেছে নেন । শিল্পী হিসেবে সেই রাষ্ট্রের অধিপতিদের কাছেও যথেষ্ট আদৃত ছিলেন কিন্তু তাঁর মনোযোগ এবং দৃষ্টি সবসময়েই ছিল প্রান্ত বা গ্রামবাংলার প্রতি । সেখানে চারুকলা শিক্ষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি তাঁর এই প্রান্ত প্রীতি বা অনুরাগকে বারবার দৃষ্টান্ত হিসেবে হাজির করেছেন । নানা প্রদর্শনীর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের লোকোশিল্পের ঐতিহ্যময় সমৃদ্ধ ভান্ডারকে যেমন সামনে নিয়ে এসেছিলেন পাশাপাশি প্রকৃত সংস্কৃতির স্বরূপটিও উন্মোচন করেছিলেন । গত শতকের পাঁচের দশকে দু’বার প্রায় বছর দুই সময় ধরে উন্নত বিশ্ব ভ্রমণ করে সেসব দেশের আধুনিক চিত্রকলা অনুধাবনের সুযোগ পান। কিন্তু তাতেও তিনি ইউরো-মার্কিন শিল্পকেন্দ্রিকতায় আকৃষ্ট হতে পারেন নি । দুবারই দেশে ফিরে তিনি শিল্পের গতিমুখ স্বদেশের লোকশিল্প ও লোকোজ-ঐতিহ্যসংলগ্ণ করার পরামর্শ দিয়েছেন । কেবল বিশ্বশিল্পভ্রভণ নয় ব্যক্তিজীবনের অভিঙ্গতা থেকেও তিনি এই বোধই ব্যাক্ত করেছিলেন যে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে নয়, দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে নিবিড় সংযোগের মাধ্যমেই ঘটতে পারে আধুনিক শিল্পের মুক্তি ।

জয়নুল আবেদিনের লোকঐতিহ্য সন্ধানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে বাংলা ও বাঙালি জাতিস্বত্ত্বা অনুসন্ধান । তাঁর ঔপনিবেশিকতা বিরোধী প্রতিবাদমূলক শিল্প অভিঞ্জান আর আধুনিক শিল্প সম্পর্কিত চেতনা—দুই একীভূত হয় একই স্রোতোধারায় । গত কয়েক দশকে ঊত্তর আধুনিক চিন্তাভাবনায় আমরা আঞ্চলিক সংস্কৃতির প্রাধান্য লক্ষ্য করেছি । ঊপনিবেশের নিজস্ব ঐতিহ্যের অনুসন্ধানকে ঊত্তর আধুনিক চিন্তাবিদরা যথেষ্ট গুরুত্বও দেন । জয়নুলের ঐতিহ্যপ্রিয়তার মুলে ছিল বাংলার সমৃদ্ধ শিল্প ভাণ্ডার তুলে ধরার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা । জয়নুল আবেদিনের মতো এমন সচেষ্ট সক্রিয়তা আর কি কারও মধ্যে ছিল? এমন ভাবনাস্রোত তো ঊত্তর আধুনিক চিন্তন প্রক্রিয়ারই সহগামী ।

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*