খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণে এবার টার্গেট মাছ? প্রশ্ন অনেক —- উত্তর অজানা

ভাস্কর ঘোষাল

কথায় আছে মাছে ভাতে বাঙালি। মাছ আর বাঙালি বলা যেতে পারে প্রায় সমার্থক শব্দ। যুগ যুগ ধরে  বাঙালির মৎস্য প্রেমের কথা বিভিন্ন শ্লোক, ছড়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয়েছে। ” লিখিব পড়িব মরিব দুঃখে/  মৎস্য মারিব খাইব সুখে ” —- মধ্যযুগের শ্লোক।

রসিকতা করে বলা হয়েছে দুটো উপায়ের কথা।  একটা হল, লেখাপড়া করা। আপনি যদি লেখাপড়া করেন, তাহলে, আপনি লিখিবেন, আপনি পড়িবেন এবং আপনি মারা পড়িবেন। সেই মরণ হবে দুঃখের মৃত্যু।  এর বাইরে আপনি করতে পারেন মৎস্য চাষ। মাছ চাষ করলে আপনি মাছ ধরবেন, মাছ খাবেন এবং সুখে-শান্তিতে কালাতিপাত করবেন।

একটা টুকরো মাছের জন্য বাঙালির নিরন্তর জীবন সংগ্রামের দিন বোধহয় শেষের শুরু হতে চলেছে। মন্ত্রী মহশায়ের হুঙ্কার তেমনই ইঙ্গিত বহন করছে।

সম্প্রতি খোদ কেন্দ্রীয় মৎস্য ও পশুপালনমন্ত্রী পুরুষোত্তম রূপালার মন্তব্য দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে বাঙালি জীবনে ৷ কয়েকদিন আগে গুজরাতে এক অনুষ্ঠানে দেবী লক্ষ্মী এবং মাছকে দুই বোন বলে উল্লেখ করে মাছকে দেবীর আসনে বসাতে শশব্যস্ত হয়ে ওঠেন স্বয়ং মন্ত্রী মহাশয়। তাঁর বক্তৃতার মাঝে তিনি বলেন’ সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর বাপের বাড়ি সমুদ্র। তিনি সমুদ্রের কন্যা।

আবার মাছও সমুদ্রের কন্যা। এক অর্থে, দেবী লক্ষ্মী এবং মাছ আসলে দুই বোন।’ মৎস্যমন্ত্রীর আরও দাবি, ‘আপনারা দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ চাইলে তাঁর বোনের আশীর্বাদও প্রার্থনা করবেন।’ ওই দিন তিনি ভাষণে মৎস্য অবতারের কথাও মনে করিয়ে দেন।
স্বাভাবিক ভাবেই  মন্ত্রীর কথায় মৎস্য প্রেমী দেশবাসী অশনিসংকেত দেখতে শুরু করেছেন। দেশের নাগরিকএই বিষয়ে ভুক্তভোগী।

আগে অনেকবারই মোদী জমানায় এই সব কট্টরপন্থীরা এদেশে খাদ্য-পানীয় থেকে শুরু করে পোশাক, আচার-আচরণ ইত্যাদি নানান বিষয়ে মতামত ও নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাঁদের মতো করে ভারতকে গড়ে তোলার নামে নানা জায়গায় অশান্তি সৃষ্টি করেছেন ৷  দেশজুড়ে গোঁড়া  হিন্দুত্ববাদীরা নিরামিষ ভোজনের প্রচার চালাচ্ছেন। গো মাতার মতো এবার কি মৎস্য অবতারের ভক্ষণ নিয়েও নিষেধাঙ্গা জারি করা হবে? ‘ ঘর – পোড়া গরু তাই সিন্দুরে  মেঘ দেখে ভয় পায়। ‘

ধর্মের জিগির তুলে সাম্প্রতিক কালে দেশের অনেক জায়গায় গো-মাংস বহন বা বাড়িতে রাখার অভিযোগ তুলে লোককে পেটানোর ঘটনা ঘটেছে। আশঙ্কা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, এবার কি মাছ ধরা অথবা খাওয়ার জন্য তেমন ঘটনারই সন্মুখীন হতে হবে?
বাঙালির কাছে ভাত আর মাছ খুবই প্রিয়। আর বাঙালি হিন্দুদের এ ভাবে মাছ খাওয়া দেখে উত্তর ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখেন। এ বারে খোদ কেন্দ্রীয় মৎস্যমন্ত্রী মাছকে লক্ষ্মীদেবীর বোনের আসনে বসিয়ে কট্টর হিন্দুদের মতকে প্রকারান্তরে সমর্থন করলেন না তো!

দেশে বাঙালিই শুধুমাত্র মাছ ধরে আর খায়,  এমন নয়। মৎস্য প্রেমে কোনও অংশে পিছিয়ে নেই ত্রিপুরা, লাক্ষাদ্বীপ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং কেরল সহ বেশ কয়েকটি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। মাছকে ঘিরে এক বিশাল অর্থনীতিও বিরাজ করছে ভারতে।  দীর্ঘ সামুদ্রিক উপকূলরেখা জুড়ে ছোট ও বড় মৎস্য বন্দর ও কেন্দ্র রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে নদী, খাল, বিল , জলাশয় ও পুকুরেও মাছ চাষ হয় ৷ মৎস্য চাষ ও উৎপাদনের সঙ্গে প্রায় ১৪৫ লক্ষ লোক যুক্ত রয়েছেন। মৎস্য রফতানি থেকে ৩৩৪.৪১ বিলিয়ন টাকা আয় হয় অর্থাৎ মাছ নিয়ে তেমন বাড়াবাড়ি কিছু করলে দেশের একদল মানুষের রুটি-রুজিতে টান পড়তে পারে ৷

পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, পশ্চিমবাংলার থেকেও এই চার রাজ্যের মানুষ শতকরা হিসেবে প্রতিদিন গড়ে বেশি মাছ খান। গোটা দেশের প্রায় সব রাজ্যের মানুষই কমবেশি মাছ খান। এখন প্রশ্ন হল মাছ নিয়ে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা কি আগামী দিনে  তেমন বাড়াবাড়ি কিছু করবে? এখানে একটা কথা বলা যেতেই পারে দেশের শাসক কুল খুব হিসেবি। তার থেকেও বলা  ভালো ঘোর ব্যবসায়ী। কোভিড প্রতিরোধে দেশের মানুষকে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দেওয়া নিয়ে কেন্দ্রের গয়ংগচ্ছ ভাব তারই ইঙ্গিত বহন করে। রাজস্ব ক্ষতি হোক এমন কোনও সিদ্ধান্তে পৌছবে না আপাত দৃষ্টিতে বলা যেতে পারে।

এক্ষেত্রে সরকারি কোনও সিদ্ধান্ত না হলেও মন্ত্রীর কথায় কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা উৎসাহিত হয়ে রাস্তায় নেমে শোরগোল বাধাতেই পারে। খাবারের অভ্যাস ও রুটি-রুজির তাগিদে বাঙালির পাশে তখন ভিনরাজ্যের মানুষ থাকবে, আশা করা যেতেই পারে। তাহলেও আশঙ্কা একটা থেকেই যাচ্ছে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*