বার্গম্যানের ছবির শব্দকল্পদৃশ্য

তপন মল্লিক চৌধুরী,

তিনি সেলুলয়েডে স্বপ্ন দেখতেন, ছবি আঁকতেন, চিন্তা করতেন, রহস্যের জাল বুনতেন, জট ছড়াতেন আবার বেদনায় আর্দ্র হতেন। সেলুলয়েড কী করতে পারে,পর্দার আড়ালে কী বিপুল মেধার কর্মযজ্ঞ লুকিয়ে থাকে সেটা বার্গম্যানের ছবি দেখলেই বোঝা যায়। অতীতকে ফিরে দেখা, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সঙ্গে নানা কিছুর সম্পর্ক স্থাপন যেন বার্গম্যানের ছবি। ‘হিরোইন’ (১৯৫৫) ছবিটির অস্থিরচিত্ত নায়িকা হ্যারিয়েট অ্যান্ডারসন একজন বয়স্ক মানুষের ঘরে অনেকগুলো পুরনো গ্রামোফোন রেকর্ড খুঁজে পান। সেগুলির থেকে একটি তুলে নিয়ে তিনি রেকর্ডেটির টাইটেল জোরে বলে ওঠেন, ‘সারাব্যান্ড’ ও ‘ব্যাক’। বার্গম্যানের অরেকটি ছবি ‘ক্রাইজ অ্যান্ড হুইসপার’ (১৯৭২), যেখানে শোকাবহ একটি সারাব্যান্ড শোনা যায়, যেটি ব্যাকের পঞ্চম সেলোর একটি সুর।  ছবির একটি মিলনের দৃশ্যে সেটি শোনা যায়। এই সারাব্যান্ডের আবার দেখা মেলে বার্গম্যানের শেষ জীবনের একটি ছবিতে। ২০০৩ সালে সুইডিশ টেলিভিশনের জন্য তার তৈরি ছবিটির নামই ছিল ‘সারাব্যান্ড’।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজের গাঁয়ে ফিরছিল এক নাইট। চলার পথে তার সঙ্গে দেখা হয় স্বয়ং মৃত্যুর। এরপর মৃত্যুর সঙ্গে সে বসে যায় দাবা খেলতে। ‘দ্য সেভেনথ সিল’ ছবিতে এমনই একটি  কল্পদৃশ্য রচনা করেছিলেন বার্গম্যান। দাবার বোর্ড আবার আমরা দেখি ‘সামার ইন্টারলিউড’ (১৯৫১) ছবিতে। একজন বয়স্ক মহিলা আর এক পাদ্রির মাঝে রাখা ছিল সেই দাবার বোর্ড। আর তার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল দুই প্রেমিক-প্রেমিকা। সেই বৃদ্ধা বলেছিল, ‘আমি বাঁচতে খুব ভালোবাসি আর তাই আমি তোমাদের অনেকের চেয়ে বেশি বেঁচেছি।’ চতুর্দশ শতকে সুইডেনের একটি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘দ্য ভার্জিন স্প্রিং’ (১৯৬০), এক পাদ্রিকে নিয়ে ‘উইন্টার লাইট’ (১৯৬৩) ছবি দুটি দেখার পর এখনো দর্শকরা আবিষ্ট হয়ে পড়েন, আসলে নাটকীয়তা এমনভাবে পরিণত হতে থাকলে দর্শকের উত্তেজনা অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়।

‘থার্স্ট’ (১৯৪৯) ছবির শুরুতেই দেখি একটি হোটেলের বদ্ধ ঘরে একটি মেয়ে। সে ধূমপান করছে, দাঁত মাজছে, সংবাদপত্র পড়ার চেষ্টা করছে এবং তার ঘুমন্ত সঙ্গীকে জাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। তখন পর্যন্ত আমরা তার সম্পর্কে কিছুই জানি না। কিন্তু আমাদের যতটুকু দরকার, সেটা আমরা জেনে ফেলি। হোটেলের ওই ঘর চিড়িয়াখানার একটা খাঁচা হতে পারে আমরা অপেক্ষায় থাকি। তারপর হঠাৎ একটি চরিত্রের মুখ দেখি, যখন সেই চরিত্রটি কোনও সংকটের মধ্যে পড়তে চলেছে। কিন্তু তাতেই কি সব স্পষ্ট হয় নাকি রহস্য আরও ঘনীভূত হয়? বার্গম্যানই আমাদের বলেন, যখন আমরা কোনো চিন্তা বা স্মৃতিতে তাড়িত হই, তখন সত্যিই তা হয়, যেমনটা হয় কারো হাতের একটা থাপ্পর আমাদের গালে পড়লে। ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’-এ আমরা কেবল একজন বুড়ো মানুষকে দেখি না যে ওই ছবির মনোযোগের মূল কেন্দ্র, তার আশপাশে সব যেন অন্ধকার, মনে হয় একটা স্পটলাইট যেন তার ওপর আলো ফেলছে।

বার্গম্যানের ছবিতে একই সঙ্গে অস্থিরতা আর ক্ষোভ যেন  প্রতিটি মুহুর্তে স্থায়ী আসন পেতে বসে আছে। সেই মুহুর্তগুলি থেকে আমরা বার্গম্যানের রহস্যের কিছু নিশানা খুঁজে পাই। তাঁর ছবিগুলিতে ধর্মীয় দর্শন খুব বেশি করেই রয়েছে। তবু তাকে কেন গির্জাসংশ্লিষ্ট বা ধর্মীয় দিক থেকে সংকীর্ণ মনে হয় না? জন্মসূত্রে বার্গম্যান বেশ দূরের মানুষ, একই সঙ্গে সেকেলেও। তিনি এসেছিলেন এক ছোট নর্ডিক জাতি থেকে, যা ধীরে ধীরে একটি রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে  তিনি মানুষের ব্যক্তিজীবনকে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গেই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তার ছবিতে মানুষের মনের নানা টানাপড়েন ও ঈশ্বরের ধারণা নিয়ে কাজ করেছেন। তার সব চরিত্রই শ্বেতাঙ্গ; তাদের অনেকেই সমাজের উঁচুতলার মানুষ; অনেকে এসেছেন থিয়েটারজগৎ থেকে। তাদের বেশির ভাগের কথোপকথনের ভাষা সুইডিশ। তো এমন চরিত্রদের কাজকর্ম কিংবা তাদের বেদনাকে আমরা মূল্য  দেব কেন? কেন সে ইসব চরিত্র আজও আমাদের ভেতরে  প্রতিধ্বনিত হতে থাকে?  এ সব প্রশ্নের উত্তরে জার্মান কম্পোজার ও সংগীতজ্ঞ ইয়োহান সেবাস্তিয়ান বাখ-এর চেলো কম্পোজিশনগুলির কথা বলা যেতেই পারে।  যেগুলো আজও মানুষ আবেগ নিয়ে নিরলসভাবে বাজিয়ে  যাচ্ছে। শতকের পর শতক পার হয়ে গেলেও সেগুলো মিলিয়ে যায়নি। বার্গম্যানের ভাবনার তল খুঁজে পেতে গেলেও আমাদের যেতে স্প্যানিশ চেলো কম্পোজার পাবলো কাসালজ-এর সঙ্গীতের কাছে। আর যদি  বার্গম্যনেরই ছবি ‘ফ্যানি অ্যান্ড আলেক্সান্ডার’ (১৯৮২)-এর ছবির থিয়েটার ম্যানেজারের কথা মনে করি, ‘আমার একমাত্র প্রতিভা হচ্ছে, আমি এই থিয়েটারের দেয়ালের ভেতরে থাকা ছোট্ট দুনিয়াটাকে ভালোবাসি। এই ছোট্ট দুনিয়ায় যারা কাজ করে, তাদের আমি খুব পছন্দ করি। বাইরের দুনিয়াটা অনেক বড়। অনেক সময় ছোট্ট দুনিয়া বাইরের বড় দুনিয়াটাকে প্রতিফলিত করতে পারে। তখন সেই ছোট দুনিয়াটা দিয়ে বড়টাকে অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারি’।

বার্গম্যান তেমনই এক নির্মাতা, যিনি এই ধরনের বহু প্রতিফলন দেখাতে পারতেন। এতটাই ভালোভাবে পারতেন যে, তার ছবি দেখতে দেখতে ধৈর্যহারা হতে হয়। বার্গম্যানের বেশির ভাগ ছবিই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু সাহসিকতায়  অনন্য। প্রতিটি চিত্রকল্পের মুহুর্ত এমন করে মনে হয় খুব কম পরিচালকই তৈরি করতে পেরেছেন। ‘আওয়ার অব দ্য উলফ’ (১৯৬৮), ‘থ্রু আ গ্লাস ডার্কলি’ (১৯৬১), ‘ক্রাইজ অ্যান্ড হুইসপার’, ‘পারসোনা’ প্রতিটি ছবি কেবল তো দেখা নয় অনুধাবন করতে করতে হয়তো জীবনের অর্ধেকটা কেটে যাবে। টুকরো টুকরো ন্যারেটিভ, শব্দ-দৃশ্যের নির্মান কৌশল দেখতে দেখতে আলসেমি ভর করে, এক ধরনের কৌতূহল উদ্রেক করে, উত্তেজনা সৃষ্টি করে, শিরদাঁড়া বেয়ে স্রোত নেমে আসে।

‘দ্য সাইলেন্স’ ছবিটি নির্বাক নয় আবার বেশি সংলাপও নেই। কোনো সাধারণ আদান-প্রদানের অভাবে সারা জীবন পাশাপাশি বাস করা মানুষগুলোর মধ্যেও যে দারুণ দূরত্ব রয়ে যেতে পারে, সেই ছবি । বার্গম্যানের সিনেমাকে একটি ডাবল থিয়েটারও বলতে পারি। তিনি ইবসেনের একজন উত্তরাধিকারী। তিনি মানুষের যন্ত্রণা ও আবেগের ক্ষতগুলো পরিমাপ করতে পারেন। একই সঙ্গে তিনি বেকেটেরও উত্তরাধিকারী। যিনি আধারে ঢাকা প্রতীকীবাদী, তিনি মেটাফোরের জন্য মনস্তত্ত্বকে পদদলিত করেছেন, যা বাস্তবতার পর্দাকে চিরে অস্তিত্ববাদী যন্ত্রণাকে তুলে এনেছে। বার্গম্যানের এই দ্বৈত সত্তার ফল হচ্ছে সিনেমা বনাম থিয়েটার। উত্তেজনায় ভরা ‘দ্য সাইলেন্স’ ছবিতে পরিবার ও সমাজ, শিল্প ও রাজনীতি, কামনা ও ভালোবাসা, আত্ম ও অন্য বিষয়গুলো তার আধুনিকতা এবং একই সঙ্গে প্যারোডির উপযোগিতাকে প্রকাশ করেছে। বার্গম্যান ছবি তৈরি করেছেন তার ব্যক্তিগত নীতি-অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে। তিনি নারীকে আবেগ, বিস্ময়, প্রশংসা, কামনা— নানা দৃষ্টিতে দেখেছেন। তার অকপট আগ্রহ তার নিজের অকপট যুক্তি ও নৈতিকতা নিয়ে তার নিজের সন্দেহের সঙ্গে মিলে গেছে। খ্রিস্ট ধর্ম ও ফ্রয়েডের প্রেক্ষিত থেকে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, নিজেকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। সামরিক আগ্রাসন, স্বৈরশাসন ও আণবিক সংহারের যুগে তিনি অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জ দিয়ে প্রতিসৃত হয়েছেন। এখানে আমরা বার্গম্যানের একটি স্ববিরোধী সত্তার সন্ধান পাই। সাধারণভাবে তাকে দারুণ আত্মকেন্দ্রিক শিল্পী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি নিজেকে প্রশ্ন করছেন, নিজেকে শাস্তি দিচ্ছেন।

বার্গম্যানের রোমান্টিক ড্রামা ‘সামার ইন্টারলিউড’ ছবিটির  শুরুতে একজন বয়স্ক নর্তকী মারি, মঞ্চের পেছনে একটি প্যাকেট পান, যার ভেতরে ছিল একটি পুরনো ডায়েরি। বার্গম্যান নোটবুকের ওপর সুপার ইম্পোজের মাধ্যমে এক সুদর্শন তরুণের ছবি দেখান।  ঠিক এর পরই সুপ্ত এক মানসিক ধাক্কা সেই নর্তকীকে আঘাত করে। মারি যখন থিয়েটার ছাড়ছেন, তখন তার পকেটে থাকা অদৃশ্য, অজানা লেখাগুলো যেন টাইম বোমার কাঁটার মতো টিক টিক করছে। থিয়েটার থেকে বেরিয়ে মারি স্টকহোম শহরে হাঁটতে থাকে। তারপর একটি ফেরি করে একটা দ্বীপে গিয়ে কিছুটা স্বস্তি পায়। ফ্লাশব্যাকে ফুটে ওঠে অনেক আগে তার এক প্রেমের স্মৃতি। ডায়েরিটা তার সেই তরুণ প্রেমিকের। এরপর মারির মনস্তত্ত্ব দেখাতে বার্গম্যানের ক্যামেরার নানা কারিকুরি দেখা যায়। সেই তরুণ-তরুণীর প্রেমের জয়গান করতে গিয়ে বার্গম্যান দেখিয়েছেন শিল্পের উৎসব।

বার্গম্যানের ‘সামার উইথ মনিকা’ ১৯৫৩  একজন তরুণের প্রেক্ষিত থেকে দেখানো একটা প্রেমের গল্প। ছবিটি ফরাসি নিউ ওয়েভ ও স্বাধীন সিনেমার টেমপ্লেটের মতো। ছবিটি একটা উপন্যাস থেকে রূপান্তর করেছিলেন। ছবিতে দেখা যায়, হ্যারি নামের এক নিঃসঙ্গ ও দ্বিধাগ্রস্ত  কিশোর শ্রমিককে। এই হ্যারির সঙ্গে পরিচয় হয় ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ১৭ বছরের এক কিশোরীর। সে কাজ করত এক মুদি দোকানে, কিন্তু তার চোখে ছিল অনেক বড় স্বপ্ন। অন্যদিকে সে হ্যারিকে প্রেমে প্রলুব্ধ করে। দুজনই কাজ ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলে চলে যায়। প্রকৃতির বিপুল ঐশ্বর্যের মধ্যে দেখা যায় তাদের প্রেমলীলা। প্রসঙ্গত, সূর্য, আকাশ আর সাগর নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার পর মনিকা গর্ভবতী হয়। বাড়ি ফিরে মনিকা এক রকম সুইডিশ মাদাম বোভারি হয়ে পড়ে। হলিউড সিনেমায় যেমনটা দেখা যায় যে, একজন নারী প্রেমের জন্যই বেঁচে আছেন, তেমনটাই হয়ে ওঠে মনিকার জীবন। তবে তার পরও বার্গম্যান তাকে কোনো উচ্ছন্নে যাওয়া নারী করেননি, বরং তাকে করেলেন প্রকৃতির এক আশ্চর্য ও শিল্পের স্পন্দন হিসেবে।

১৯৬৫ সালে বার্গম্যান তার সিনেমার ক্রুদের ফারো দ্বীপে নিয়ে যান। এটা ছিল বাল্টিক দ্বীপে একটা সুইডিশ সমরিক ছাউনি। বার্গম্যানদের উদ্দেশ্য ছিল ‘পারসোনা’ ছবির শুটিং। ছবি একজন নার্স আর তার রোগীর কথা। নার্সটি কথা বলেন, রোগী নীরব। ধীরে ধীরে দুজনের আত্মপরিচয় একে অন্যের মধ্যে লীন হতে শুরু করে। ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে বার্গম্যান রয়্যাল ড্রামাটিক থিয়েটারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। পদটি সামলানো তখন বেশ কঠিন ছিল। কারণ পুরো প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে শুরু করার দরকার হয়েছিল। নিজেকে বেশ একটা ঝামেলাপূর্ণ পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করেন বার্গম্যান। কিন্তু নিজের সিনেমার কাজকেও তিনি অবহেলা করতে পারছিলেন না। ফলত ভয়ানক পরিশ্রম যায় তার। ফলস্বরূপ ডাবল নিউমোনিয়া ও পেনিসিলিনের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি। ১৯৬৫ সালের বসন্তে তাকে রয়্যাল হসপিটালে ভর্তি করা হয়। এখানেই হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি পারসোনার চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন। বার্গম্যানের কথায়, ‘আমি আমার হাতকে সৃষ্টিশীল কাজে অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলাম।’ হাসপাতালে শারীরিক ও মানসিকভাবে খারাপ এক পরিস্থিতিতেই তিন শিল্পের ভূমিকা ও নিজের কাজকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। বার্গম্যান তার ইমেজেস: মাই লাইফ ইন ফিল্মে লিখেছেন: ‘পেশাগত জীবনের প্রতি আমার  কোনো বিতৃষ্ণা নেই। আমি কিছুটা খেপাটে মানুষ, কিন্তু সেটা কোনোভাবেই আমার পেশাগত জীবনে প্রযোজ্য নয়। নিজের ভেতরে থাকা দানবগুলোকে বেঁধে রাখার সামর্থ্য আমার আছে। এবং আমি তাদের আমার দরকারমতো কাজে লাগাতে পারি। একই সঙ্গে তারা আমার ব্যক্তিগত জীবনকে যন্ত্রণা দিতে থাকে।’

‘পারসোনা’ নিয়ে বার্গম্যান প্রথম নোটটি লিখেছিলেন ১৯৬৫ সালের ১২ এপ্রিল: ‘নিরাশা, বেদনা ও কান্না পরিবর্তিত হয়ে মানুষের আনন্দের শক্তিশালী প্রকাশে পরিণত হয়। আমি এ সিনেমার মাধ্যমে নতুনভাবে শুরু করতে চাই’। ‘পারসোনা’ ছিল বার্গম্যানের ক্যারিয়ারে একটা আরম্ভ। তিনি নিজেই বলেছেন যে, একটা নতুন শুরু। ওই  নোটবুকের আরেকটু পরে কিছু শব্দ পাওয়া যায়, যা সিনেমাটার সঙ্গে খুব সম্পর্কযুক্ত: ‘টক টু ইচ আদার’, ‘ইরোটিসিজম’, ‘টেস্টিমোনি’, ‘ফেসিয়াল স্টাডিজ’ ইত্যাদি। পারসোনার মূল দুই নারী চরিত্রকে অনেক সময় একটিই ভাবা হয়। এরকম ভাবার পেছনে উপযুক্ত কারণও আছে। খোদ বার্গম্যানই বলেছেন, ‘আমি মনে করি, এটা একই আত্মার বিভিন্ন স্বরের সমন্বয়।’

বার্গম্যানের ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরি’ সবেচেয়ে বেশি নকল হয়েছে, ‘দ্য সেভেনথ সিল’ নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্যারোডি হয়েছে। আর সবেচেয়ে বেশি লেখালেখি হয়েছে ‘পারসোনা’ নিয়ে। বার্গম্যানের আর কোনো ছবি এত বেশি সমালোচনা ও একাডেমিক বিতর্কের জন্ম দিতে পারেনি। অনেক সমালোচক এটিকেই বার্গম্যানের জীবনের সেরা কাজ বলে মনে করেন। পারসোনা নিয়ে বার্গম্যান নিজেই বলেছেন: ‘পারসোনা আমার জীবনকে রক্ষা করেছিল। এটা একটুও বাড়িয়ে বলা নয়। এ সিনেমাটা তৈরির শক্তি যদি আমি না পেতাম, তাহলে আমি স্রেফ ভেসে যেতাম। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই প্রথমবারের মতো আমি সিনেমার বাণিজ্যিক সাফল্য নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আমি পারসোনায় আমার সাধ্যের সব দিগন্তকে স্পর্শ করেছি। ‘পারসোনা’ ও ‘ক্রাইজ অ্যান্ড হুইসপার’ করতে গিয়ে আমি শব্দহীন কিছু রহস্যকে স্পর্শ করেছি, যা সিনেমা ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে আবিষ্কার সম্ভব নয়।’  

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*