চলমান ছবি কথা বলবে তাই ৭০ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ চলচ্চিত্র নির্মানে আকৃষ্ট হলেন

তপন মল্লিক চৌধুরী,

নাটক লেখা এবং অভিনয়ের প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে বিশেষ অনুরাগ তা তাঁর লিখিত নাটকের সংখ্যা থেকেও অনুমান করা যায়। সংখ্যার বিচারে নাট্য রচনায় তিনি শেক্সপিয়ারকেও পিছনে রাখেন। যেখানে শেক্সপিয়ারের নাটক সংখ্যা ৩৭ সেখানে রবীন্দ্রনাথের নাট্য সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। রবীন্দ্রনাথ কেবলমাত্র নাটক লিখেই থামেন নি, ক্রমাগত অভিনয়েও অংশগ্রহণ  করতেন। মাত্র ষোল বছর বয়সে তিনি জোড়াসাঁকোর  ঠাকুর বাড়ীর পারিবারিক নাট্য মঞ্চে প্রথম অভিনয় করে বেশ সুনামও অর্জন করেছিলেন। রবীঠাকুরের প্রথম অভিনিত নাটক ছিল তাঁর বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘হঠাৎ নবাব’।

এর পর একে একে ‘অলীকবাবু’ নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয়, ১৮৮১ সালে ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ নাটকে ঋষি বাল্মীকির ভূমিকায়, পরের বছর নিজের রচিত ‘কালমৃগয়া’ গীতিনাট্যে অন্ধমুনির চরিত্রে, ১৮৮৯ সালে নিজের রচিত ‘রাজা ও রানী’ এবং ১৮৯০ সালে ‘বিসর্জন’ কাব্যনাট্যেও অভিনয় করেছেন। নাটক, গীতিনাট্য ও কাব্যনাট্য ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ বেশকিছু প্রহসন রচনা করেছিলেন। তার মধ্যে ‘গোড়ায় গলদ, ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ প্রহসনে রবীন্দ্রনাথ কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।

১৮৯০ সালে বিসর্জনে তরুণ রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ রঘুপতির ভূমিকায় অভিনয় করেন। ৩৩ বছর পর ১৯২৩ সালে ওই একই নাটকে প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ যুবক জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেন।  রবীন্দ্রনাথ ১৯১১ সালে ‘শারদোৎসব’ নাটকে সন্ন্যাসী এবং ‘রাজা’ নাটকে রাজা ও ঠাকুরদাদা দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘অচলায়তন’ নাটকে অদীনপুণ্যের ভূমিকায় অভিনয় করেন, ১৯১৫ সালে ‘ফাল্গুনী’ নাটকে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় এবং ১৯১৭ সালে ‘ডাকঘর’ নাটকে ঠাকুরদা, প্রহরী ও বাউলের ভূমিকায় অভিনয় করেন।

কেবলমাত্র নাটক নয় চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তার নাটক ‘তপতী’ বৃটিশ ডমিনিয়ন ফিল্মস লিমিটেড ১৯২৯ সালে চলচ্চিত্রে রূপদান করে। শান্তিনিকেতনে শুটিং হওয়া ওই চলচ্চিত্রে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ। ৮ রিলের সেই চলচ্চিত্রের হাতধরেই রবীন্দ্রনাথের রূপালি পর্দায় আবির্ভাব। ১৯৩০ সালের ২৬ জুলাই রবীন্দ্রনাথের কাহিনী অবলম্বনে প্রথম বাংলা নির্বাক চলচ্চিত্র ‘দালিয়া’ মুক্তি পায়। রবীন্দ্রনাথের কাহিনী অবলম্বনে ১৯৩২ সালে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘চিরকুমার সভা’ মুক্তি পায়।

১৯২৭ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রথম নটীর পূজা নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। এরপর ১৯৩১ সালের শেষদিকে রবীন্দ্রনাথ আবার নাটকটি মঞ্চস্থ করার উদ্দেশ্যে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় আসেন। সেই সময় নিউ থিয়েটার্স ক্যালকাটার প্রতিষ্ঠাতা বীরেন্দ্রনাথ সরকার রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানান নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে নাটকটিকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করার জন্য।

তবে চলচ্চিত্র নির্মানের আগে প্রযোজক বীরেন্দ্রনাথ এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চুক্তি হয়েছিল ওই চলচ্চিত্রের লভ্যাংশের অর্ধেক শান্তি নিকেতনের জন্য দান করতে হবে। সেই প্রস্তাব মেনেই নটীর পূজা চলচ্চিত্রের কাজ শুরু হয়। প্রায় ৭০ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ পরিচালনা করলেন একটি চলচ্চিত্র। চলমান ছবি কথা বলবে, এই বিষয়টি আকৃষ্ট করলো রবীন্দ্রনাথকে। চলচ্চিত্র যখন বিকশিত হচ্ছে সে সময়ই ছবি পরিচালনা করলেন রবীন্দ্রনাথ।

নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও’র ১ নম্বর ফ্লোরে মাত্র ৪ দিন শুটিং করে এ চলচ্চিত্রের নির্মান কাজ শেষ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ এ চলচ্চিত্রটি পরিচালনার পাশাপাশি একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয়ও করেন। নটীর পূজা-র ক্যামেরাম্যান ছিলেন নিতেন বসু। সঙ্গে ছিলেন ইউসুফ মুলাজী। আর সম্পাদনায় ছিলেন সুবোধ মিত্র। কবিকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়েছিলেন সুবোধ মিত্র। তার চেয়ারে বসেই কবি সম্পাদিত ফিল্মগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন।  

চলচ্চিত্রটি সেন্সর সার্টিফিকেট পায় ১৯৩২ সালের ১৪ মার্চ। এর দৈর্ঘ্য ছিল ১০ হাজার ৫৭৭ ফুট। নটীর পূজা ১৯৩২ সালের ২২ মার্চ কলকাতার ‘চিত্রা’ পরবর্তীতে মিত্রা সিনেমা হলে মুক্তি পায়। নিউ থিয়েটার্স কর্তৃপক্ষ মনে করেছিলেন, যেহেতু রবীন্দ্রনাথ নিজে এই ছবিতে অভিনয় করেছেন তাই ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবে। কিন্তু ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে অসফল হয়। ছবিটির ব্যর্থতার জন্য মঞ্চায়নের ভঙ্গিতে চলচ্চিত্রায়ণের পদ্ধতিই যে দায়ী সে কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই বুঝেছিলেন। অন্যদিকে প্রযোজক বীরেন্দ্রনাথ অল্পদিনের শুটিং করাকেই এই ছবির বাণিজ্যিক ব্যর্থতার কারণ হিসেবে মনে করেছিলেন। তবে সেসময় অনেক চলচ্চিত্র সমালোচকই ছবিটির নান্দনিক মূল্যের প্রশংসা করেন। ছবিটি বানিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় আর কোনও চলচ্চিত্র পরিচালনা কিংবা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি।

শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও অভিনয় করেছিলেন ললিতা সেন, সুমিতা চক্রবর্তী, লীলা মজুমদার প্রমুখ। ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শব্দ গ্রহণ করেন মুকুল বসু। তবে চলচ্চিত্রের কলাকৌশল ও রীতিনীতি কতটা অনুসৃত হয়েছিল সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কারণ ‘নটীর পূজা’ চিত্রের প্রিন্ট চিরতরে হারিয়ে গেছে।

১৯৪০ সালে নিউ থিয়েটার্সে আগুন লেগে গেলে অনেক ছবির প্রিন্টের সঙ্গে নটীর পূজার নেগেটিভও পুড়ে যায়। এখন শুধু একটি আংশিক ১৬ মিলিমিটার ফিল্ম রাখা আছে রবীন্দ্র ভবনে। তবে রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য সেই খড়ের চালের গোলঘরও হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য।

1 Comment

  1. খুব ভাল লেখা। বিষয়টা জানা ছিল কিন্তু এত বিস্তারিতভাবে নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*