দূর বিদেশ থেকে সবাইকে জানাই শুভ বিজয়ার প্রণাম ও ভালোবাসা

অদ্রিজা বসু : কলকাতা থেকে ৮ হাজার মাইল দূরে নিউইয়র্ক শহরে বসে সবাইকে জানাই শুভ বিজয়ার প্রীতি, শুভেচ্ছা, প্রণাম ও ভালোবাসা। আমার প্রাণের শহরে এখন দুর্গাপুজো শেষ হলেও রেশ কাটেনি তার। বেশ কিছু পুজোর প্যাণ্ডেল থাকবে এখনও কয়েকদিন। নিউ মার্কেট থেকে বাবার শার্ট আর দক্ষিণাপন থেকে মায়ের শাড়ি এবার আর নিজে পছন্দ করে কেনা হলো না। ছোট্টোবেলায় বিশ্বকর্মা পুজো থেকে শুরু হয়ে যেত আমার পুজো। আসমানি আকাশের বাঁধনহীন রঙবেরঙের ঘুড়িগুলির মতো ঘুরে বেড়াতো আমার পুজোর আনন্দ। আর নিজের বাড়িতে ‘দুগ্গাপুজো’ মানে অবর্ণনী আনন্দ। দাদুর সাথে পটুয়াপাড়ায় গিয়ে মাঝে মাঝে তাগাদা দিয়ে আসা। লাল রঙের খেরোর খাতাটা থেকে দশকর্মা ভাণ্ডারের বহু পুরোনো ফর্দ বার করা। অবাক চোখে ভাবতে বসা যে, দুর্গামায়ের পুজোর জন্য   জল, আরও কত কিছু লাগবে।

পুজোর ঠিক আগেই আমাদের বাড়িতে আসত মুকুন্দ ফুলওয়ালা। আর আলতা পরানো দিদা। বিস্মৃতির দায় নিয়ে বলছি, ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর নামটা।

দুর্গা ঠাকুর ও তাঁর পরিবারবর্গের জন্য স্মৃতিমা (আমার দিদা) পরম যত্নে বানিয়ে রাখত নারকেল নাড়ু, খইয়ের উখরা, মুড়ির মোয়া আরও কত কিছু। অবশ্য মা দুর্গার আগেই সেই প্রসাদের ভাগ জুটত আমার আর ভাইয়ের কপালে।

এখানে আমার জানালার লোহার গ্রিলটার ফাঁক দিয়ে শরৎ আকাশের পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘগুলোর দিকে যখনই তাকাচ্ছি, তখনই মনে হচ্ছে আমার ছোটোবেলার পুজোর আনন্দগুলোকে নিয়ে ওই মেঘের আড়ালে কোথাও লুকিয়ে আছে আমার দিদা আর দাদু।

এই দেশে নাই-বা পেলাম হইহল্লা, কলোরব, নাই-বা পেলাম হারিয়ে যাওয়া অনেক স্মৃতি। তবু শরৎ প্রকৃতি তার সোনা রঙের মিঠে রোদ্দুর ছড়িয়ে সাদা মেঘের ভেলায় চেপে সাত সাগর পাড়ে এই দূর দেশেও আসে। তাই তো প্রতি বছর এখানে শারদীয়া আসে। নিউইয়র্কে বাংলাদেশ হিন্দু মন্দিরের পুজোয় এবার আমার পুরো পরিবার নিয়ে আনন্দ করলাম। মা-বাবা-ভাই পুজোর সময় এসেছিল আমাদের কাছে। মন্দির থেকে আমার ভাই ভোগ প্রসাদ নিয়ে আসছে আমি, আমার স্বামী তথা পুরো পরিবারের জন্য। এটাই বাঙালিয়ানা। যা সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে অটুট।

 

বাবা অভীক বসু ও মা সোমা বসু আড্ডা বসিয়ে দিয়েছেন এখানকার মানুষদের সঙ্গে। পুজোর প্রেসিডেন্ট শ্যামল চক্রবর্তী আমেরিকায় ২৭ বছর ধরে আছেন। বর্তমানে ধর্মকর্ম নিয়ে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকলেও একনিষ্ঠ কবিতা প্রেমিক তিনি। রবীন্দ্রনাথ ওঁনার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস।

দেখতে দেখতে পুজোর দিনগুলো চলে গেল। আজ মায়ের নিরঞ্জন। মনে পড়ে ছোট্টবেলায় উপোস করে আলপনা দেওয়া, পটুয়াপাড়া থেকে মা কবে আসবেন তার অধীর অপেক্ষা করা, পুজোয় ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে শিউলি ফুল তোলা, চন্দনবাঁটা, পদ্মফুলের কুঁড়ি ফোটানো—কত স্মৃতি এই পুজোকে ঘিরে। মা বিদায় নিলেও দেবীপক্ষ চলছে। বর্তমানে দেশ তথা সারা পৃথিবী জুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টায় মেতেছে কিছু অশুভ শক্তি। মা দুর্গা সেই অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন বলে আমার বিশ্বাস। আমার বাবার একটি পুজোর ছড়ার সঙ্গে সুর মিলিয়ে এই লেখা শেষ করছি— ‘শঙ্খে শঙ্খে গাও মঙ্গলগীতি, মা এসেছেন ঘরে তাই সম্প্রীতি।’

(লেখিকা নিউইয়র্কে শিক্ষকতা করেন এবং গুয়াহাটি আইআইটি-র প্রাক্তন রিসার্চ স্কলার)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*