নিখরচায় মদযোগ

সুস্মিতা রায়

ক্লাবে বিলটা মিটিয়ে দীপন দেখল তার পকেট একেবারে হালকা, সঙ্গে ছিল অনিক দা। তারও একই অবস্থা। রিমিকে বলে এসেছিল, আজ দক্ষিনাপন এ পছন্দ করা শাড়িটা নিয়ে যাবে। গুজরাট এম্পোরিয়াম থেকে পূজা র জন্য ঘাগরা! কিছুই হল না। সব মদ এর বিল দিতেই চলে গেলো। ক্রেডিট কার্ড এ কিনতে সাহস হয় না। এমনিতেও প্রতি মাস এ মোটা টাকা দিতে হয়। টেবিল এ বসে ক্লাব এর কর্মী বিলু কে মনে মনে গালাগালি দিল দীপন, ব্যাটা এক মনে বসে মদ এর হিসাব লিখছে। মুখে মিচকে হাসি! অনিক দাকে বলতে সে উদাস মুখ করে বললো ওর আর কি দোষ! মালিক যা বলেছে তা ই তো করবে! আর দেখ,তুই আমি কত মাস এ গেলাস এর পর গেলাস ধার এ উড়িয়েছি। সত্যি, দীপন মুখ গোমড়া করে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।

ক্লাব এর মিউজিক সিস্টেমে দারুন সব গান বাজছে।সবাই কেমন হাসিখুশি, ফুরফুরে মেজাজে। শুধু দীপন আর অনিক এর পকেটই ফাঁকা। কড়কড়ে নোট গুলো শুধু রঙিন জলের দাম মেটাতেই চলে গেল! কিছু ক্ষন পর উদাস গলায় দীপন বললো, অনিক দা। বল, একই উদাসী গলা। ভাবছি আর কখনো মদ ছোব না।

আমিও তাই, করুন গলায় উত্তর অনিক এর। মাল খেয়ে বাড়ি গেলে তোর বউদি খুব রাগ করে। ছেলে বড় হচ্ছে তো।
আর রিমি র কথা ভাবো, আজ ওর পছন্দের শাড়ি নিয়ে যাব বলে আশা করে আছে। কি যে করি! কিছু টাকা ধার দাও তো।
কি করবি? পকেট হাতড়ে অনিক বললো। পুজার জন্য ঘাগরা। না রে অত টাকা নেই, দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালো অনিক।

তবে আর কি হবে, টেবিল থেকে উঠে পড়ল দীপন। এক মনে মাথা নীচু করে হিসাব লিখতে থাকা ক্লাব এর করমি বিলু কে মনে মনে গালাগালি দিল। শালা, আজ ই সব টাকা না মেটালে যেন ক্লাব উঠে যেত! কতদিন পর ভাবলাম আজ অল্প কয়েক পেগ খাব,তা না, বকেয়া টাকা দিতেই সব চলে গেল। অনিক টেবিলে চাটি মেরে তবলা র বোল তুলছিল। দীপন বিরক্ত মুখে বেয়ারাকে ডাকল। দেখলো আড় চোখে বিলু ও তাকাল ওই দিকে। মনে মনে ফের বিলু কে তুলোধুনো করল দীপন।।ইচ্ছে হল চেচিয়ে বলে, আরে বাবা ধার এ মদ চাইছি না। আজ খেলে নগদ এই খাবো। অনিক এর দিকে তাকিয়ে বলল, আজ কিন্তু তোমার আমার ফিফটি ফিফটি। ওকে,,দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিক বলে,তবে বেশি খাস না, পকেট ফাঁকা!

তিন পেগ পেটে পড়ার পর দীপন বললো, অনিক দা, আজ ই মদ খাওয়া শেষ, ভাল করে সেলিব্রেট করি এসো, তাকে সমর্থন করে অনিক আর ও এক পেগ এর অরডার দিল। নেশা টা যখন বেশ জমে উঠেছে, ক্লাব এ এসে ঢুকলো দুজন এর বন্ধু বিতান। তাদের টেবিলে বসে বলল, আজ কার ঘাড় ভাংলে গুরু!! দীপন, অনিক দুজন এই নিজেদের দেখিয়ে বললো আর কার!!

ওহ,,বিতান মুখে চুকচুক শব্দ করে বলল, নিজেদের ঘাড় এ মাল এর খরচ বইছ গুরু!! কতদিন আর চালাতে পারবে!!
যত দিন চলে,অনিক উদাস গলায় বলে। এরপর বাড়ি থেকে বউদি বিদায় করে দেবে যে,,, বিতান বলে। সে যখন হবে,তখন দেখা যাবে,, করুণ স্বর এ বলে দুজন। বিতান আর ও ঘন হয়ে আসে, অন্য দের কান বাচিয়ে বলে, তার থেকে মাল এর খরচ অন্য র ঘাড় এ চাপাও।

সে কি করে হবে!!.জানতে চায় দীপন।।চোখ মটকে বিতান বলে, সে অনেক পথ আছে। আমায় দেখে শেখো। মাল আমি ও খাই,তবে নিজের পয়সায় না। তবে?? অবাক হয়ে জানতে চায় দীপন অনিক। সে ভাল দেখে মুরগি ধরতে হয়,বিতান রসিয়ে রসিয়ে বলে। এর নাম হল নিখরচায় মদযোগ!!, তবে শুধু তরল না, সঙ্গে ভাল খাবার ও থাকবে। শিবরাম চক্রবর্তী র নিখরচায় জলযোগ পড়েছ তো,,,এটা তার নব তম সংস্করণ বলতে পার,, বলে সে মিটি মিটি হাসতে লাগল।

বিতান এর কথা শুনে দীপন আর অনিক মুখ চাওয়া চাওয়ি করল, এটা ঠিক, এই ক্লাব এ তাদের আসা যাওয়া খুব বেশি দিন না। এক বন্ধুর মাধ্যমে এখানে আসা। তারপর মাঝে মাঝে আসা, একটু পান করা এই আর কি,,,সারাদিন কাজ এর পর শরীর মন কে একটু আনন্দ দেওয়া,,,তবে তাই করতে গিয়ে পকেটে যেভাবে টান পড়ছে,,চিন্তা র ব্যাপার। তাদের কথা বারতার মাঝেই বেয়ারা উদয় হল, বিতান কে ডাকতে। তার কোন বন্ধু এসেছে। দীপন অনিক এর দিকে চোখ মটকে বিতান বলল,চলি রে আমার কথা টা মাথায় রাখিস,ঠিক পথ বার হয়ে যাবে।

রাস্তায় নেমে দীপন বলল,বিতান কথা টা খারাপ বলে নি, নিখরচায় মদযোগ!! দিনকাল যা পড়েছে, আমাদের ও ভাবতে হবে। না হলে হোম ফ্রন্টে আর টেকা যাবে না।আমার ও এক ই হাল রে,করুণ গলায় জানায় অনিকও। কদিন পর ক্লাবে দেখা।অনিক কে দীপন বলল, আজ ব্যবসা র প্রথম দিন।
তার মানে?? অবাক হয় অনিক, কিসের ব্যবসা করবি?
তেমন কিছু না, নিখরচায় মদযোগ,, এই আর কি! দূর, ওই সব বাদ দে, পরের মাথায় কাঠাল ভাংগা! ওই সব এ আমি নেই,,অনিক বলে।

চুপ করো, দীপন রাগত স্বরে বলল, সেদিন রিমি অফিসে এসেছিল। তো কি?? অনিক অবাক হয়ে জানতে চায়।
আর বল না, সোজা এম ডি র ঘর এ গেল। পরে একাউন্টটেন্ট এসে জানাল, মাইনে র টাকা নাকি রিমির ওখানে যাবে। ছি ছি….ভাব কি কারবার! অফিস এ মুখ দেখান মুস্কিল…আমার মত মাতাল স্বামী নিয়ে নাকি ওর সংসার চালানো সমস্যা হচ্ছে!

কেন ওকে সংসার খরচ দিস না? দি তো,বিরক্ত গলায় দীপন বলে,তা ও দেখ প্যানপ্যানানি র শেষ নেই… মাঝে মাঝে একটু যা মদ খাই… তা ও নিজের পয়সায় , সেটা ও ওর সহ্য হয় না!
হু, অনিক চিন্তিত ভাবে বলে, ব্যাপার টা সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে, তুই মদ খাওয়া ছেড়ে দে দীপন। আমি ও ছেড়ে দেব এই সব।
দূর… তুমি ও বকধার্মিক হয়ে গেলে দেখছি, কত সমাজ সেবা করছি ভাবো!

তার মানে? মদ খেয়ে সমাজ সেবা?? কি সব বলছিস??
বা রে, এই যে তুমি আমি সারা দিন খাটাখাটুনি র পর এক দু পাত্র চড়াই, এতে সরকারের কত লাভ হয় জানো! আর সরকারের লাভ মানেই জনসাধারণের লাভ, তাদের সেবা করা। আজ আগেই কত পাত্র চড়িয়েছিস?? অনিক সন্দেহের সঙ্গে বলে। এক টা ও না, দীপন হেসে বলে, তবে এবার খাব, তা ও একদম পরের পয়সায়,,নিখরচায় মদযোগ,,,কথা টা ভাল ই বলেছে বিতান, তাই না??

কে খাওয়াবে তোকে রোজ বিনা পয়সায়? আর কেন ই বা খাওয়াবে? অনিক জানতে চায়। আরে দেখ ই না কি হয়! আমাদের পেশা টা ভাবো, এটা কে ই পুজি করে এগবো এবার কিন্তু কি ভাবে?? আরে দেখ ই না, এবার চুপ করে বসে থাক । আমার ক্লায়েন্ট আসছে। বলতে বলতে ই এক যুগল এর দিকে ইংগিত করে দীপন। অল্পবয়সী দুটি ছেলে মেয়ে ক্লাবে এসে ইতিউতি তাকিয়ে দীপন কে দেখে এগিয়ে এল।

আসুন আসুন, তাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানায় দীপন, অনাবিল হেসে অনিক কে দেখিয়ে বলে, এই আমার বন্ধু,অনেক গুলো টিভি সিরিয়াল করছে, ওর কথা ই বলছিলাম আপনাদের, অনিক কিছু বলতে যেতে ই তার পা য়ে চাপ দিয়ে থামিয়ে দেয় দীপন। ছেলে মেয়ে দুজন গদগদ ভাবে নমস্কার জানায় অনিক কে। কিছু খেতে খেতে কথা বলা যাবে, বেশ গম্ভির গলায় দীপন বলে হ্যা হ্যা নিশ্চয়ই, ছেলে টি বেয়ারা কে ডেকে খাবার এর অরডার দেয়, সঙ্গে পানীয় ও।
ওরা দুজন ই অনিক কে মুগ্ধ চোখে দেখছে। দীপন নিরবিকার। ভ্রুক্ষেপহীন। খাওয়া হলে পকেট থেকে দামি পারস বার করে দাম মিটিয়ে দিল ছেলে টি। যাওয়ার সময় দীপন বলল, আলাপ পরিচয় তো হল। এরপর দরকার হলে খবর দেব।

ওরা চলে যেতে ক্ষোভ এ ফেটে পড়ল অনিক। আমি আর কখনও আসব না তোর সঙ্গে। তুই এই ভাবে আমায় টিভি সিরিয়াল এর লোক বানালি। তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে দীপন বললো, আরে এখন নেই, পরে তো হতেই পার! বলে সে ফুরফুরে মেজাজে গান ধরলো, একটা মুরগি বধ হল,আবার একটা আসবে। যাব না যাব না করেও দীপন এর সঙ্গে আর ও কয়েক টা ” মুরগি ” বধ এর শরিক হল অনিক ও। ঠিক ই তো, তাদের এই চাকরি টা ই এক ধরন এর বিনিয়োগ বলা যায়। সরাসরি পরিচালক, প্রযোজক না হলেই বা, প্রায় এক ধরনের গরিমা র কাজ তো তারা ও করে। বিতান,দীপন এর বুদ্ধি আছে বলতে হবে। আর এটা এমন কিছু ব্যাপার না, মাঝে মধ্যে তাদের একটু পান করাতে গরিব হয়ে যাবে না ওই সব অবস্থাপন্ন ঘর এর ছেলে মেয়েরা।

মনের মধ্যে থাকা বিবেক এর কাটাটাকে এই ভাবে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে সে। এই ছাড়া দীপন এর বক্তব্য, এখন না হোক, পরে যে তারা এই ধরনের কাজ করবে না, তা কে বলতে পারে! এখন তো এই সব বিনোদন এরই যুগ, এই ধরনের চিন্তা ভাবনা তার মাথায় আছে বলে অকপটে জানায় সে। অতএব মাঝে মধ্যে তাদের এই নিখরচায় মদযোগ চলতে থাকে। হঠাত একদিন দুজন এর দেখা হতে ই খুশি খুশি ভাব। দুজন এর বউ ই অনেক দিন পর তাদের মা বাবার বাড়ি গেছে। কবে আসবে তা বলে যায় নি।। যতদিন খুশি ওখানে থাকুক এমন ই মন এর ভাব তাদের। অনিক এর সঙ্গে দেখা হতেই দীপন ফূর্তি র স্বর এ বলে, চল গুরু, আজ বাড়ি তে ই আসর বসাই! ফ্রিজ এ কদিন ধরে গোয়া র কাজু ফেনি রাখা আছে, আজ ওপন করি!! তাই চল,,খুশি তে ঝলমল অনিকও। একটু দাঁড়াও, দীপন বলে, আজ একটা মুরগি আসার কথা আছে। ছাড় না, অনিক বলে, এবার ওই সব বাদ দে।

আরে দেখিই না একবার,মিচকে হাসে দীপন, বলতে বলতেই তার মুখ ফ্যাকাশে, অনিক কে বলে, ওই দেখ কারা আসছে!!
তাকিয়ে দেখে অনিক, বিস্ময় এ হা হয়ে যায় সে, বাপ রে এ তো চেনা ই যাচ্ছে না, রিমি আর সৃজা!! কি সেজেছে দুজন! এত দিন এর চেনা বউ কে অচেনা লাগছে!! কিন্তু ওরা এখানে কেন??

অনিক দীপন এর হাত চেপে ধরে, ওরা মনে হয় আমাদের খুজতে এসেছে। আজ তুই প্রযোজক হ, আমি পালাই।
দূর পালাবো কেন, তাকে সাহস যুগিয়ে দীপন বলে, ওরা এখানে কেন দেখতে হবে, চল আড়ালে যাই। আড়ালে যাওয়া আর হল না, তার আগে ই এক মুখ হাসি নিয়ে এগিয়ে এসেছে তাদের চেনা ছেলেটি। রিমি সৃজা কে দেখিয়ে হেসে বলছে, আজ এই দুজন লাভলি লেডি কে আনলাম স্যার, একদম ফ্রেশ, নায়িকা ছাড়া আর কিছু মানাবে বলে মনে হয় না!!
সামনে সুন্দর বনের বাঘ দেখলেও বোধ হয় এমন মুখের ভাব হত না তাদের।

অতএব নিখরচায় মদযোগ পর্বের এখানেই ইতি!!

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*