আধুনিক নৃত্যের উদয়াকাশ

ভাস্কর ঘোষাল

সিনেম্যাটিক ফ্রেম তাঁকে ভাবিয়েছিল আজীবন। নিজের ঘরানার নাচে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বডি এক্সপ্রেশনের ওপর। যেখানে মুদ্রার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শরীরী ভাষা। রাজস্থানে জন্ম  উদয়শঙ্কর চৌধুরীর। মনে-প্রাণে ছিলেন পুরোদস্তুর বাঙালি। জীবনের প্রথম দিকে উদয়শঙ্কর নাচ শুরু করেননি। সংগীত এবং আলোকচিত্র শিল্পের দিকেই তাঁর বেশি নজর ছিল। নাচ এসেছিল তাঁর জীবনে সহজাতভাবে।

লন্ডন কলেজ অফ আর্টস-এ ভর্তি হওয়ার পর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যুগলবন্দীতে  শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী শিখেছিলেন তিনি । অনেক নতুন নতুন  তত্ত্ব ও তথ্যের সঙ্গে সেসময় পরিচয় ঘটেছিল তাঁর। ভারতের আধুনিক নৃত্যের অগ্রগামী নাম উদয় শঙ্কর।  তিনি ছিলেন একজন প্রতিথযশা নৃত্যশিল্পী, নৃত্য পরিকল্পক এবং অভিনেতা। ভারতীয় শাস্ত্রীয় ও উপজাতীয় নৃত্যের উপাদানগুলির সঠিক সমন্বয় করেছিলেন তিনি।  যা পরবর্তী কালে বিশ্বের দরবারে সমাদৃত। 

নৃত্যে কোনও প্রথাগত প্রশিক্ষণ ছিল না উদয় শঙ্করের।  বাড়ির প্রভাবে ছোট বয়স থেকেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় এবং লোক নৃত্যের শৈলীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। ইউরোপে থাকাকালীন তিনি ব্যালেতে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।  এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে  উভয় শৈলীর উপাদানকে সমন্বিত  করে নৃত্যের একটি নতুন শৈলী আবিষ্কার করার চিন্তাভাবনা করেছিলেন।  যাকে ‘ হাই-ডান্স ‘ বলা হয়ে থাকে। 

ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের স্বরূপ এবং প্রতীককে নৃত্যে রূপ প্রদান করেছিলেন এই গুণী শিল্পী।  লন্ডনে থাকার সময়ে নৃত্যশিল্পী হিসেবে উদয় শঙ্করের প্রথম আবির্ভাব।  সেখানকার আইভি হাউসে নৃত্য প্রদর্শনের সময় প্রখ্যাত রাশিয়ান ব্যালেরিনা আনাপাভলোভা তাঁর পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হন।  পরবর্তীকালে আনাপাভলোভা প্রাচ্য নৃত্যকলার প্রতি আগ্রহী হয়ে প্রাচ্য ওরিয়েন্টাল নৃত্য প্রশিক্ষণ দেবার জন্যে উদয় শঙ্করকে তাঁর দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। যা  শিল্পীর জীবনে সাফল্য  ও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।

আনাপাভলোভার অনুরোধে উদয় শঙ্কর ‘রাধাকৃষ্ণ’ ও ‘হিন্দু বিবাহ’ নামে দুটি ভারতীয় নৃত্য রচনা করেছিলেন।   ‘রাধাকৃষ্ণ’ নৃত্যে  উদয় শঙ্কর নিজেই  রাধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পাশ্চাত্য সমাজের অনুরাগীদের হৃদয় জয় করেছিলেন।
দেশে ফিরে কেরালার গুরাভাযুরের একটি মন্দিরে নৃত্য অনুষ্ঠানে ‘কথাকলি’ নৃত্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন উদয়শঙ্কর। সেই নৃত্য   শৈলীকে শেখা এবং গভীরভাবে জানার জন্যে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। সেই সময় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করে   শাস্ত্রীয় ও লোক নৃত্য সংগ্রহ ও করেছিলেন।

প্যারিসে The Compagnie Uday Shankar de Dance Musique Hindous নামে একটি নৃত্য ও সঙ্গীত কোম্পানি স্থাপন করেন। শিল্পীঅক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তুলেছিলেন ‘গন্ধর্বনৃত্য’, ‘সাপুড়েনৃত্য’, ‘রাধাকৃষ্ণনৃত্য, ‘তলোয়ারনৃত্য’ এবং ব্যালে হিসেবে ‘শিবপার্বতী’, ‘লেবার এ্যান্ড মেশিনারী’, ‘রিদম অব লাইফ’ প্রভৃতি নৃত্য। প্যারিসে অনুষ্ঠিত  এই নৃত্য গোষ্ঠীর  নজরকাড়া অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদয় শঙ্করের নৃত্য জীবনের  জয়যাত্রার  সূত্রপাত হয়।

উদয় শংকর দেশে ফিরে উত্তরপ্রদেশের  আলমোড়ায় বিখ্যাত ওস্তাদ শঙ্করণ নামবুদ্রীক, কন্দপ্পন পিল্লেই, আমোবি সিংহ ও আলাউদ্দীন খাঁ-কে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন   ‘উদয় শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’। সংগীতের পথপ্রদর্শক  উদয় শঙ্কর  দেশের  বিভিন্ন স্থান ঘুরে  সংগ্রহ করেছিলেন নানা ধরণের বাদ্যযন্ত্র।সেই সকল ভারতীয়   বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র এবং  নিজস্ব শব্দ তরঙ্গ তৈরি  করেছিলেন তিনি।  বিদেশী যন্ত্রের ব্যবহার  উদয় শংকর তাঁর নিজের দলে কখনো  করেননি।

উদয় শঙ্করের  অগণিত  সৃষ্টির  বিশেষ   দিক হল, ‘শ্যাডো প্লে।  যেখানে তিনি সাদা পর্দার ওপর নতুন আলো ছায়ার ধারা সৃষ্টি  করার কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন। শুধুমাত্র নৃত্যশিল্পী নন, চিত্র পরিচালক উদয়শঙ্করের শিল্প ও সৌন্দর্যতত্ত্বও চিরস্মরণীয়। ছোটোবেলায় জেনেছিলেন ফটোগ্রাফির ফ্রেম, সেখান থেকেই হয়তো জন্ম নিয়েছিল ‘কল্পনা’র কল্পনাশক্তি। তাঁর পরিচালিত ‘ কল্পনা ‘ শিল্প সৃষ্টির এক বিশেষ বার্তা বহন করে। চল্লিশের দশকের গোড়ায় উদয়শঙ্কর ঠিক করলেন শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলীর উপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। আর সেই চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রে থাকবে শুধু নাচ। তাঁর সেই চিন্তাভাবনা আলোর মুখ দেখেছিল ১৯৪৮ সালে। এটিই তাঁর একমাত্র চলচ্চিত্র।  

শুধু সিনেমা নয়, ভারতের শিল্প – সংস্কৃতি জগতে ‘ কল্পনা ‘ মাইলস্টোন। চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর ফ্যান্টাসির ক্যানভাসে ধরা পড়ল ভারতের নৃত্যের ইতিহাস— সেটাই ছবির মূল বিষয়। বিংশ শতকে ‘ কল্পনা ’র  মধ্য  তিনি ধরে রেখেছেন শ্যাডো ডান্স, সোর্ড ডান্সের মতো আধুনিক নৃত্য। আবার কথাকলি, মণিপুরি, ভরতনাট্যমের মতো ধ্রুপদী নাচও।

বিভিন্ন ধারার নাচ তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল।   এই সিনেমায় তিনি রোবটের ছবি এঁকেছিলেন। আজকের দিনে আমরা  জ্যাজ, ব্যালে, সালসায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে চর্চায় মশগুল থাকি। নিজের দেশের ডান্স ফর্ম সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। শিল্পী ‘ কল্পনা ‘ তে সেই ফর্মই ধরে রেখেছেন। 

উদয়শঙ্করের গ্রেট ক্রিয়েশন ‘ কল্পনা ‘ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় এক জায়গায় বলেন ” আমি ভেবেছিলাম নৃত্যশিল্পী হিসোবে তিনি যতই মহান হন, সিনেমা সম্বন্ধে তাঁর কতটা ধারণা থাকা সম্ভব? ছবিটা রিলিজের দিনই আমি দেখেছি। তারপর আরও অনেক বার দেখেছি। ‘ কল্পনা ‘ নির্ভেজাল সিনেমা, এ দেশে যে সিনেমা হত তার থেকে একেবারে আলাদা। কম্পোজিশন, আলোর ব্যবহার, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ভীষণ সাবলীল। “

দর্শকমহলে তেমন সাড়া পায়নি। কিন্তু উদয়শঙ্করের ‘কল্পনা’ এরকমভাবেই ঘোর লাগিয়েছিল তাবড় সমালোচকমহলে।
পরবর্তীকালে  ‘শঙ্করস্কোপ’ ও ‘সামান্য ক্ষতি’ নৃত্য নাট্যের নবসংস্করণ  ছিল তাঁর জীবনের শেষ কীর্তি। ধ্রুপদী ও লোকনৃত্যেকে ভিত্তি করে উদয়শঙ্কর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছিলেন। পৌরাণিক ও আধুনিক ভাবধারার সংমিশ্রণে আধুনিক রুচি ও ধ্যানধারণার মানানসই করে নতুন নতুন ভাবধারার সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। প্রাচ্য নৃত্যকলার আঙিনায় উদয় শংকর স্বয়ং এক প্রতিষ্ঠান। সমগ্র  বিশ্বকে এই উপমহাদেশীয় শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করানো, মূলত নৃত্যকলার প্রতি শ্রদ্ধাবনত করার কর্মযজ্ঞ তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবনের শ্রেষ্ঠতম অবদান বললেও অত্যুক্তি হবে না।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*