গান্ধীজি সম্পর্কে না জানা কিছু কথা

তপন মল্লিক চৌধুরী,

কোনও দিন যে ছেলে স্কুলে যেতে দেরি করে নি। সেই ছেলে ইস্কুল পালাত। কারণ ইস্কুলে মোহনদাসের কোনও বন্ধু ছিল না। এক তো ছিলেন খুব লাজুক। তার ওপর গায়ে শক্তি ছিল কম। তাঁর মনের মধ্যে সবসময় একটা ভয় কাজ করত, কেউ বুঝি তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাসা করবে। প্রথম দিকে লেখাপড়ায় মোটেও ভালো ছিলেন না। ইস্কুলে মাস্টারমশায়দের বকুনির ভয়ে রোজ স্কুলে পড়া মুখস্ত করে যেতেন। মোহনদাস ছেলেবেলা থেকেই খুব বিনয়ী। নিজের কৃতিত্বের কথা কেবল কমিয়ে নয়, একেবারেই বলেন না। বরং তাঁর কী দোষ ও দুর্বলতা আছে সেকথাই বলতেন। তিনি বলতেন, তাঁর বুদ্ধি কম, স্মরণশক্তিও তেমন মজবুত নয়। কিন্তু সত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ সেই শৈশবকাল থেকেই। তাঁর স্কুলে শিক্ষা বিভাগের ইনসপেক্টর জাইলস সাহেব আসার ঘটনা জানেন না এমন ভারতীয় খুজে পাওয়া যাবে না। ছাত্ররা কে কেমন ইংরেজি শিখছে জানার জন্য জাইলস পাঁচটা বানান লিখতে দিয়েছিলেন। মোহনদাস ‘কেটল’ বানানটা ভুল লিখেছিলেন। মাস্টারমশায় ইশারা করছিলেন, যাতে সে পাশের ছেলের খাতা দেখে বানানটা ঠিক করে নেয়। গান্ধীজি বুঝেছিলেন সেটা করা সত্যের অপলাপ। পরে মাষ্টারমশায়ের বকুনি শুনবেন জেনেও তিনি তা করেননি।

হাইস্কুলের উঁচু ক্লাসে মোহনদাস ভাল রেজাল্ট করতেন। মোহনদাস মেধাবী ছাত্রের স্বীকৃতি পান। তখন থেকে শিক্ষকরা তাঁকে ভালোবাসতেন। গান্ধীজি আত্মজীবনীতে সেকথা উল্লেখ করেছেন খুব কুণ্ঠার সঙ্গে। অথচ নিজের দুর্বলতার কথা বলেন খুব জোরের সঙ্গে। ব্যায়াম ছিল তাঁর অপছন্দের বিষয়। একসময় জ্যামিতি নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছিলেন। ইউক্লিডের ১৩ নম্বর উপপাদ্য-র পরে অবশ্য জ্যামিতির মজা তিনি পেতে থাকেন। সংস্কৃত বরাবরই শক্ত লাগত। মোহনদাস স্কুলজীবনে একটা ব্যাপারে খুব অবহেলা করেছিলেন- হাতের লেখা। তাঁর হাতের লেখা কখনই ভালো ছিল না। ভালো করার চেষ্টাও করেননি। অনেক পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যারিস্টারি করতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল, খারাপ হস্তাক্ষর অশিক্ষার লক্ষণ। কিন্তু সেই বয়সে হাজার চেষ্টা করেও আর হাতের লেখা ভাল করতে পারেননি।

হাইস্কুলে মোহনদাস এক বন্ধুর পাল্লায় পড়েছিলেন। যাকে তাঁর মা, বড় দাদা ও স্ত্রী, তিনজনেই দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। প্রসঙ্গত, ১৩ বছর বয়সে মোহনদাসের বিয়ে হয়। বয়সে কিশোর হলেও, স্বামী হিসাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কড়া ও সন্দেহপ্রবণ। যাই হোক মোহনদাস তাঁর বন্ধুটিকে পছন্দ করতেন। আত্মজীবনীতে গান্ধীজি লিখছেন, ছেলেবেলায় তিনি দুর্বল ও ভীতু ছিলেন। কিন্তু বন্ধুটি ছিল একেবারে উলটো। সে সাহসী ও শক্তিমান, লংজাম্প আর হাইজাম্প, দু’টোই ভালো পারত। মার খেয়ে সহজে কাবু হত না। মানুষ তার নিজের মধ্যে যে গুণ নেই, পরের মধ্যে যদি সেই গুণ দেখে, তার দিকে আকৃষ্ট হয়। মোহনদাসও সে কারণে ছেলেটির প্রতি আকর্ষণ বোধ করত। সেই বন্ধুর পাল্লায় পড়েই মোহনদাসের প্রথম মাংস খাওয়া। যদিও তাঁর পরিবার পরম বৈষ্ণব। ছেলে মাংস খেয়েছে শুনলে বাবা-মা মনে হয়ত শোকেই মারা যাবেন। কিন্তু বন্ধু তাঁকে বুঝিয়েছে, মাংস না খেলে ভারতবাসীরা শক্তিশালী হয়ে উঠবে না। ব্রিটিশকে পরাজিত করতে পারবে না।

গান্ধী জীবনে মোট পাঁচ-ছ’বার মাংস খেয়েছিলেন। তারপর দেখলেন, বাবা-মাকে লুকিয়ে নিষিদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা ঠিক হচ্ছে না। গোপনীয়তা মানে এক ধরণের মিথ্যাচার। তাই ঠিক করলেন, বাবা-মা জীবিত থাকতে আর মাংস খাবেন না। কিশোর বয়সে তিনি ধূমপান করেছিলেন। পয়সা চুরি করেছিলেন। আত্মহত্যাও করতে গিয়েছিলেন একবার। বাবাকে চিঠি দিয়ে চুরি করার অপরাধও স্বীকার করেছিলেন। এই সব কথা  কিশোর বয়সে তিনি ধূমপান করেছিলেন। পয়সা চুরি করেছিলেন। আত্মহত্যাও করতে গিয়েছিলেন একবার। শেষে বাবাকে চিঠি দিয়ে চুরি করার অপরাধও স্বীকার করেছিলেন। এই সব কথা কিশোর বয়সে তিনি ধূমপান করেছিলেন। পয়সা চুরি করেছিলেন। আত্মহত্যাও করতে গিয়েছিলেন একবার। শেষে বাবাকে চিঠি দিয়ে চুরি করার অপরাধও স্বীকার করেছিলেন। এই সব কথা মোহনদাস পরিণত বয়সে লিখেছেন।

মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ বইয়ের ভূমিকাতেই তিনি বলছেন, আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যা পেয়েছি, তা অভ্রান্ত এমনটা আমি দাবি করছি না। বৈজ্ঞানিক যেমন কখনও ভাবে না সে এক্সপেরিমেন্ট করে যা পেয়েছে, তাই চরম, আমি নিজের জীবনের পরীক্ষাগুলি সম্পর্কেও তাই মনে করি। গোপরাজু রামচন্দ্র রাও-এর বই ‘অ্যান এথেইস্ট উইথ গান্ধী’তে ধর্ম ও নাস্তিকতা নিয়ে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের বর্ণনা আছে। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের অধ্যাপক। ঘোর নাস্তিক। ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার করার জন্য তাঁকে কলেজের চাকরি ছাড়তে হয়েছিল। তিনি ছিলেন মহাত্মার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দলিত-নিপীড়িত মানুষের সেবা করতেন। গান্ধীজির ডাকে সাড়া দিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। জেলও খেটেছেন। ১৯৩০ সালে গান্ধীজির ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

নাথুরাম গডসের গুলিতে নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে গান্ধী নাকি তাঁর আশু পরিণতি টের পেয়েছিলেন। শেষ ৪৮ ঘণ্টায় তেমন কিছু অদ্ভুত নজির ছিল। ওই সময় তিনি কাছের ও প্রিয় মানুষদের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন, তিনি হয়তো তাঁদের মাঝে বেশি দিন নেই।  মাই এক্সপেরিমেন্ট উইদ গান্ধী। প্রমোদ কাপুরের লেখা এই বইয়ে মহাত্মার জীবনের এমন সব ঘটনার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। বইটিতে আছে, ১৯৪৮ সালের ২৯ জানুয়ারি বিকেলে গান্ধীজির কাছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গৃহহারা একদল বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী এসে অভিযোগ তোলে, তাদের ক্ষয়ক্ষতির জন্য গান্ধীই দায়ী। তারা এ কথাও বলে, ‘আপনি আমাদের শেষ করে দিয়েছেন। এখন আমাদের পরিত্রাণ দিন; আপনি তল্পিতল্পা নিয়ে হিমালয়ে চলে যান।’ সন্ধ্যায় তিনি তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী নাতনি মানুবিনকে বলেন, ‘ওই মানুষগুলোর করুণ কণ্ঠ ছিল ঈশ্বরের কণ্ঠের মতো। এটাকে তোমারা আমার মৃত্যুর পরোয়ানা মনে কর’।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*