আজকে সবই গুলজারিস

মাসানুর রহমান

দৈনন্দিন জীবনের সুখ, দুঃখ, ভাব, রাগ, অভিমান, কষ্ট প্রভৃতি আবেগকে গানের মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলা যেন তাঁর খেলা। চমৎকার আবৃত্তি করতে পারেন তিনি। আবৃত্তি এবং কোনো ঘটনার সংলাপ বলার ভঙ্গি যে কাউকে সেটা শুনতে বাধ্য করবে। চিত্রনাট্য তৈরিতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার…. আসলে আজ আমরা কথা বলছি যাঁকে নিয়ে তিনি কবি গুলজার..!!

সত্তর দশকে হিন্দি সিনেমার জগতে যখন শুধুই মারপিট আর এ্যাংরি ইয়ং ম্যানের যুগ চলছিল ঠিক তখন ভিন্ন ধাঁচের গল্প, ভিন্ন ধাঁচের প্রেক্ষাপট ও ভিন্ন আখ্যানভাগের সিনেমা দর্শকদের উপহার দেন গুলজার।

বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক ও গীতিকার ছিলেন গুলজার। গীতিকার হিসেবে সাফল্য অর্জনের পর তিনি ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসেন। বলা যায় হিন্দি চলচ্চিত্রে কিছু পরীক্ষামূলক কাজের ক্ষেত্র তিনিই প্রথম তৈরি করেছিলেন। গান নির্মাণের ক্ষেত্রে তার অবদান অসামান্য। তার লেখা গানের প্রতিটি কলি থেকে যেন জীবনের গভীর ভাব প্রকাশ পায়। চারপাশে যা ঘটছে তা দিয়েই খুব সহজ করে সুন্দর সুন্দর গান লিখতে পারেন।

দিল্লীতে পড়াশুনার শুরু হয় কবি গুলজারের। পরে বোম্বেতে একটি মোটর গ্যারেজে দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ির রংয়ের মিশ্রণ এবং রং মেলানোর কাজ করতেন। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি আলাদা নেশা ছিল। গ্যারেজে কাজ করার সময় রাতে কিছু করার ছিল না বলে সেখানেও বই পড়তেন। গ্যারেজের কাছেই ছিল একটি লাইব্রেরি। মাত্র চার আনায় সেখান থেকে বই নিয়ে পড়া যেত। সেখান থেকে গোয়েন্দা গল্প ও রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনী দিয়ে শুরু করেছিলেন। এরপর একদিন তার হাতে এলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যগ্রন্থ মালীর ইংরেজি অনুবাদ Gardener। এটি পড়ার পর গুলজারের বই পড়ার ভাব এবং ধরন পুরোপুরি বদলে যায়। এমনকি বই নির্বাচনের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসে। সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়।

এরপর তিনি পড়েন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলো। শরতের উপন্যাসগুলোতে তিনি বড় পরিবার এবং পরিবারের মানুষদের জটিল সম্পর্কগুলোকে দেখতে পান। একপর্যায়ে তিনি এসব উপন্যাসের চরিত্র এবং চরিত্রের ভাবের সাথে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার মিল খুঁজে পান। সেই তখন থেকে তিনি বাংলা ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি হিন্দি চলচ্চিত্রে কাজও শুরু করেন আরেক কিংবদন্তী বাঙালি বিমল রয়ের সাথে। বিয়েও করেন রাখী গুলজার নামে এক বাঙালিকে। রাখী গুলজার নিজেও চলচ্চিত্রের আরেক কিংবদন্তী অভিনেত্রী।

কবি গুলজারের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো তিনি সাহিত্য বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। ভিন্ন ধারার সিনেমাগুলো তৈরি হতো ভালো কোনো সাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাস থেকে। গুলজারের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি আগে থেকেই সেসব গল্প-উপন্যাস পড়ে রেখেছেন। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের সাথে পরিচয় থাকার কারণে চরিত্রগুলোর আবেগ, অনুভূতি সম্পর্কে তার ভালো ধারণা থাকতো। সে কারণে চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোকে মূল গল্পের চরিত্রের সাথে মিলিয়ে অভিনয় করতে কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সমস্যা হতো না। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেরে আপ্নে’তে কোনো পরিচিত মুখ নেননি। ভারতের National School of Drama থেকে অভিনয় শিখে আসা অভিনেতাদের নিয়ে তিনি চলচ্চিত্রটি তৈরি করেন। এ চলচ্চিত্রটি পরবর্তীতে সুবিশাল ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের মর্যাদা অর্জন করে।

একবার কবিতা লেখা নিয়ে তাকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল- কবি হতে গেলে এবং কবিতা লিখতে হলে কি কাউকে উদাস হতেই হবে? উদাসী না হলে কি কবিতা লেখা যাবে না? তখন কবি গুলজার চমৎকার একটি উত্তর দিয়েছিলেন- মানুষের জীবনে উদাসীনতা একটু বেশী সময় ধরে থাকে, আর সুখ কিংবা আনন্দ হয় অনেকটা ফুলঝুরি বা আতসবাজির মতো যেটা বেশী সময় থাকে না। নিমিষেই আলো দিয়ে ফুঁড়িয়ে যায়। কিন্তু উদাসী অনেকটা আগরবাতির মতো। চারদিকে নিজের বাসনা বা গন্ধ ছড়িয়ে দেয়।

একথা অনস্বীকার্য যে তিনি যা-ই লিখেন না কেন, সেটা গান হোক, সংলাপ হোক, গল্প কিংবা উপন্যাস-চিত্রনাট্য হোক, তার লেখা প্রতিটি শব্দই জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর কলমের স্পর্শে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*