রেড লাইট এরিয়া থেকে এসে চুনীবালা যদি না ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেন…

তপন মল্লিক চৌধুরী,

‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পায় ১৯৫৫-র ২৬ আগস্ট,  তার কয়েকমাস আগেই চলে গিয়েছিলেন চুনীবালা দেবী। যিনি কেবলমাত্র ‘পথের পাঁচালি’র ইন্দির ঠকরুন চরিত্রের অভিনেত্রী নন, সত্যজিতের প্রথম ছবির  অন্যতম বিস্ময়। বয়সও হয়েছিল তাঁর। যখন ইন্দির ঠাকরুন চরিত্রের জন্য তাঁকে  নির্বাচন করা হয় তখনই তিনি অশীতিপর। ‘পথের পাচালি’ আখ্যানে দুর্গার মতো তাঁরও বাস্তবে মারণ জ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল। তবে তিনি ‘পথের পাঁচালি’ দেখে গিয়েছিলেন মুক্তি পাওয়ার আগেই। সত্যজিৎ রায় বুঝতে পেরেছিলেন তাঁকে আর বেশিদিন সময় দেবেন না চুনীবালা। তাই মুক্তির জন্য আর অপেক্ষা না করে পরিচালক সত্যজিৎ  একদিন প্রোজেকটর আর ছবির রিল বয়ে নিয়ে গিয়ে হাজির হয়ে যান চুনীবালা দেবীর বাড়ি। সেখানেই প্রোজেকশনের ব্যবস্থা হয়। নিজে যে ইতিহাসের শরিক হয়েছিলেন সেটা তিনি আর দেখে যেতে পারেন নি। কিন্তু যে ছবিতে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে অমর হয়ে আছেন তা তিনি চোখে দেখে গিয়েছিলেন। চুনীবালা দেবী একথাও জেনে যেতে পারেন নি যে তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি সম্মানিত হয়েছেন বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসবে। ম্যানিলা চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিবেচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার অনেক আগেই এপারের মায়া কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। দিন ফুরিয়ে আঁধার হওয়ায় ইন্দির ছবিতে হরির কাছে পার্থনা করেছিলেন ওপারে নিয়ে যাওয়ার। তাঁর হরিও খুব বেশিদিন তাকে অপেক্ষায় রাখেন নি। সত্যিই তো দিন পেরিয়ে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল | ছোট্ট ঘটি ডোবায় ভাসিয়ে ইন্দির ঠাকরুন চলে গিয়েছিলেন অনেক দূরে নিশ্চিন্দিপুরের ঘন বাঁশবাগানের মাথায় যেখানে জোনাকিরা জ্বলে‚ সেখানে ….আর চিত্রপরিচালক হিসাবে সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম ছবিতেই ইতিহাসের পাতায় জায়গা পেয়ে গিয়েছিলেন।

১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসের এক রবিবার সত্যজিৎ তাঁর ছবির ইউনিট আর উমা দাশগুপ্ত, সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনিবালা আর এক শিশু অভিনেত্রী রুন্কি বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লোকেশনে হাজির হন। যে দৃশ্যের শট টেক করা হবে সেটা ছিল এরকম: ইন্দির ঠাকরুণ বারান্দায় বসে বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দুধে-ভেজানো মুড়ি খাচ্ছেন, আর দুর্গা দু’হাতে একটা রুপোলি রঙের ফিতে আস্তে আস্তে জড়াচ্ছে খুলছে এবং ইন্দির ঠাকরুণের খাওয়া দেখছে। চুনীবালা এত ভাল অভিনয় করেন যে সুব্রত মিত্র ক্যামেরা বন্ধ করতেও ভুলে যান এমনকি সত্যজিৎ, ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে চুনীবালার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বংশী চন্দ্রগুপ্ত  একটু  দূর থেকে সেটা লক্ষ করে চেঁচিয়ে ওঠেন: ‘কী হল মানিক? কাট বলো!’ তার আগে অবশ্য কাশফুলের জঙ্গলে টেলিগ্রাফের খুঁটি আর ওই অপু-দুর্গার দৃশ্যটা তোলা হয়েছিল।

সকলেই জানেন চুনীবালা দেবীকে সত্যজিৎ আবিস্কার করেছিলেন কলকাতার বিখ্যাত পতিতা পল্লী থেকে। অশীতিপর ইন্দিরা ঠাকুরণ চরিত্রের জন্য সত্যজিৎ খুঁজছিলেন এমন এক মুখ যিনি বৃদ্ধা কিন্তু অভিনয়টা জানেন। শ্যুটিং-এর ধকল নিতে পারবেন। মনে রাখতে পারবেন সংলাপ, মনে রাখতে পারবেন পরিচালক তাকে যেমনটা বলছেন ঠিক সেরকম মুভমেন্ট এবং এক্সপ্রেশন। সত্যজিৎ কম বয়সী কাউকে মেক আপ দিয়ে বৃদ্ধা সাজাতে চাননি। কিন্তু বহু খুঁজেও মনমতো কাউকে পাচ্ছিলেন না যাঁকে দিয়ে ম্যানারিজম-বর্জিত অভিনয় করাতে পারবেন। অবশেষে তার ছবির আর এক অভিনেত্রী রেবা দেবী যিনি ছবিতে অভিনয় করছিলেন ধনী জমিদার গিন্নির চরিত্রে। তিনি পুরনো দিনের অভিনেত্রী চুনীবালা দেবীর খোঁজ দেন।

দেরি না করে সত্যজিৎ প্রোডাকশন ম্যানেজার অনিল চৌধুরীকে নিয়ে হাজির হয়ে যান চুনীবালার ঘরে। দরজায় টোকা দিতে দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলেন তিনিই বিভূতিভূষণের ইন্দির ঠাকরুণ। পতিতালয়ের বাসিন্দা বৃদ্ধাকে বলা হল অভিনয় করতে হবে তাঁকে। শুনে অত্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন তিনি। অ-ভি-ন-য় !! সে যেন গতজন্মের কথা। যদিও তিনি বহুযুগ আগে থিয়েটার করতেন। ফিল্মেও সুযোগ এসেছিল ১৯৩০ সালে। তখন তাঁর বয়স পঞ্চান্ন। অভিনয় করেছিলেন বিগ্রহ, রিক্ত প্রভৃতি ছবিতে। তাঁকে নিয়ে ফিল্মবন্দি করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচালনায় ‘নটীর পুজা’। থিয়েটারের চুনীবালা দেবী ছবিতে এসে পার্শ্বচরিত্র হয়েই থেকে গিয়েছিলেন মাত্র। অপাংক্তেয় দিন কাটছিল পতিতালয়ে। অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার জন্যই যেন না মরে বেঁচেছিলেন ছিলেন তিনি। এরপর পথের পাঁচালী আর তারপর বাকিটা ইতিহাস। পথের পাঁচালী ছবিতে চুনীবালার পারিশ্রমিক ছিল রোজ কুড়ি টাকা। তার বেশি আর কিছুতেই সম্ভব ছিল না সত্যজিৎ রায়ের পক্ষে, নিদারুন অর্থ সঙ্কট, নিজের বীমার কাগজ পত্র‚ স্ত্রীর গয়না সব বন্ধক দিতে হয়েছে ‘পথের পাঁচালি’ সেলুলয়েড বন্দি করতে।

সেদিন পতিতালয় থেকে বেরিয়ে যে চুনীবালা ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর পরনে শতচ্ছিন্ন সাদা থান। আর যে অভিনয় তিনি করেছিলেন তাতে পরিচালক ও ইউনিটের সকলের আশা ছাপিয়ে গিয়েছিল। একদিন গাড়ি থেকে নামার পরে তাঁকে বলা হয় ‚ কিছু মনে করবেন না, আজ মরে যাওয়ার দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইন্দির ঠাকরুন ওরফে চুনীবালা দেবী বলেন‚ ‘আরে! এ তো অভিনয়! কিছু মনে করব কেন ?’

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*