নিজস্ব বিশ্বাসে অহংকারী যে কবি

তপন মল্লিক চৌধুরী,

আমি আর আসবো না। / প্রতিটি নামের শেষে, আসবো না। / পাখি, আমি আর আসবো না। / নদী, আমি আর আসবো না। / নারী, আমি আর আসবো না, বোন। আজ অতৃপ্তির পাশে বিদায়ের বিষণ্ণ রুমালে / কে তুলে অক্ষর কালো, ‘আসবো না’ / সুখ, আমি আসবো না। / দুঃখ, আমি আসবো না। / প্রেম, হে কাম, হে কবিতা আমার /  তোমরা কি মাইলপোস্ট না ফেরার পথের ওপর?

মানুষকে স্বপ্ন দেখাতেন যিনি, বেঁচে থাকার সাহস যোগাতেন যিনি সেই কবি মহাকালে পাড়ি জমালেন। এ তো এক ক্ষতি, কার? বাংলার, সাহিত্যের। এ ক্ষতি এক গভীর ক্ষত হয়ে থাকবে। যদিও তার অনবদ্য সৃষ্টি হাজিরা দেবে মাঝেমধ্যেই কারন তা অবিনশ্বর।

চেতনার দুর্ভেদ্য দুর্গ কবি কি এই মুহুর্তে অনুপস্থিত? তবে তো কাব্যপ্রেমী, সাহিত্যপ্রেমীরা সেটা অনুভব করবে প্রতি মুহূর্তে। কবির শান্ত, সুস্থিত, প্রাণবন্ত ঔদার্য, নিরপেক্ষতা বাধ্য করবে ভাবাতে। সীমাহীন শূন্যে প্রাণ মিলিয়ে গেলেও কবি জাগিয়ে রাখবেন।

বাস্তবতার সংঘাতে স্রোতের প্রতিকূলে যে কবি দাঁড়িয়ে ছিলেন তাকে তো তাঁর হার্দিক দৃঢ়তা বলেই জানবো। কেবল সাহসীরাই পারে স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড়াতে। আর ভীরুরা স্রোতের টানে কেবলই ভেসে যায়। ক’জন কবি পারেন স্রোতের গতিই পরিবর্তন করে ফেলতে।

এই সব পারা, বেঁকে বসা, ঝুঁকে না পড়া, নুয়ে না থাকা স্রোতের গতি পরিবর্তন করতে জানা তাঁর বিরুদ্ধে অনেকেই কথা বলছে তবু তিনি হাসছেন, লিখে চলেছেন। তিনি অদম্য সাহসী যোদ্ধা, তিনি রণ অক্লান্ত কবি আল মাহমুদ। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন বাংলার কাছে, বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি সাধনে, তার বিস্তার ঘটাতে তাই তিনি তার মত ও পথে হেঁটেছেন নিরলস নিরবধি।

কেবলমাত্র কবিতা তো নয়, বাংলা কথাসাহিত্যেও অদম্য শক্তিশালী এই প্রতিভা এক বিরাট অহংকার। ‘প্রকৃতপক্ষে জীবন এক রহস্যঘন অশ্রুসজল অতিক্রমণ। সে ধীরে পার হয়, আস্তে কথা বলে, এবং শেষ পর্যন্ত অশ্রুসজল হয়ে পরিসমাপ্তি ঘটাতে চায়। কোথাও না কোথাও সমস্ত যাত্রারই একটা শেষ থাকে। জীবনেরও শেষ থাকবে এটাই নিয়ম’। এমন জীবন দর্শনের কথা পাই তাঁর “সাহসের সমাচার” গ্রন্থে।  কী আশ্চর্য সেই চিরন্তন নিয়মকে গ্রাহ্য করেই অনতিক্রম্য উচ্চতায় উপনীত কীর্তিমান কবি আল মাহমুদের জীবনাবসান।

অনন্তের আহবান আগে থেকেই শুনতে পেয়েছিলেন, একমাত্র কবি শুনতে পান বোধহয়। তাই একটি কলামে কবি চলে যাওয়া সম্পর্কে নিজেই লিখেছিলেন ‘আমি যাচ্ছি উদ্দেশ্যহীন এক অপরিসীম পথের টানে’। আবার একথাও লেখেন -‘মাটির শীতলতা আমার মর্মে হাত বুলিয়ে না দিলে আমি শান্তি অনুভব করবো না। আমার জন্য কেউ যদি মৃত্যুর শীতলতা বুলিয়ে দিতে পারতো, তাহলেই আমার বিশ্রাম হতো’।

জীবনের মূল্যবোধ জাগানিয়া, মঙ্গল প্রত্যাশী,  মাতৃভূমির কল্যাণকামী, স্বপ্ন, সত্য,  প্রগতি ও সমাজ বদলে বিশ্বাসী কবি কবিতায় বার্ধক্য-মৃত্যুকে সুরে-ছন্দে উপভোগ্য করতে চেয়ে লিখলেন ‘বদনখানি নেতিয়ে পড়া হাল ভাঙা এক নাও / তাহার মাঝে বিরাজ করে তার বাঁধা এক লাও। / লাওয়ের খোলে গান বেঁধেছি, /‘সোনার ময়না রে / পিঞ্জিরা তো প্রাচীন হইল এবার উড়াল দে’।

জীবনে বৈরি সময় তো কম আসেনি, এসেছে বহুবার। কিন্তু কবিতার উঠান ছেড়ে কোথাও যাননি কোনো দিন। যেকোনো অনুশাসন– তা জীবনের হোক বা সাহিত্যের, অথবা সমাজের – তিনি প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন এক রাজকীয় অবহেলায়। ১৯৯০ দশক থেকে ব্যক্তি জীবনে ইসলামের অনুবর্তী হয়ে কবি আল মাহমুদ সমালোচনার শিকার হয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ইসলামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এবং নিজেকে একজন বিশ্বাসী মুসলমান মনে করতেন। এটা নিয়ে তার কোনো রাখ-ঢাক ছিল না।

কবিতায় প্রেম আর সরলতা প্রাধ্যন্য ছিল বলেই সকলেই মুহূর্তে লুফে নিয়েছে তাঁর কবিতা। কিন্তু শেষের দিকে ধর্মীয় উন্মাদনায় কেন মিলে গেল, বোঝা যায় নি। পবিত্র আল-কুরআনকে নিজের সংবিধান এবং রাসূল সা.-কে পথ প্রদর্শক মেনেছিলেন। আর এই বিশ্বাসের কারণে তাকে নানামুখী সমালোচনা শুনতে হয়েছে, গঞ্জনাও সইতে হয়েছে অনেক। ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই তিনি সব সময় বললেও তাকে রাজনৈতিক লোক মনে করা হতো। এই অপবাদে কবি বিব্রত হয়েছেন। অনেককেই খারিজ করে দিয়েছেন। এমনকি জীবনানন্দকেও। সম্ভবত, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তার এই পরিবর্তন।

কল্যাণ ও শুভচিন্তার কবি, উদয়-অস্ত অনুভবের কবি আল মাহমুদ। সোঁদামাটির, বাংলাদেশের লোকজীবনের, আবহমানকালের চিরায়ত কবি আল মাহমুদ। সংস্কৃতিকে ভালবাসার, ঘরের কোণে ডাহুকের ডাক কান পেতে শুনেছেন তিনি।  স্বপ্ন, ছন্দ, গন্ধ নিংড়িয়ে সৌন্দর্যের রস সৃষ্টি করেছেন কবি আল মাহমুদ। স্বপ্নের ভিতর জেহাদ সৃষ্টি করেছেন আল মাহমুদ। দোখজের ওমে পুড়েও ছারখার না হয়ে জেগে উঠেছেন  কবি আল মাহমুদ। আর বাংলা কবিতা, সাহিত্য তার মননের বিচ্ছুরণে অসামান্য হয়েছে। সাহিত্যকাশ হয়েছে ঋদ্ধ। আমরা হয়েছি চিরঋণী।

এরপর ‘পরিসমাপ্তির বিশ্রাম’।  তিনি যে অজানা গন্তব্যে পৌঁছতে স্রষ্টার কাছে নিজের বাসনা তুলে ধরেছেন সেখানেই তিনি ঠাই পেলেন কিনা জানিনা তবে তার জন্যই আকুল প্রার্থনা ছিল তাঁর- ‘কেন জানি মনে হয় আমি যেভাবেই যাই শেষ পর্যন্ত তোমার কাছে গিয়ে পৌঁছুব। / যা ফেলে এসেছি তা কোনোদিনই যেমন ফিরে পাবো না / তেমনি সামনে থাকবে না পাওয়ার অন্ধকার। না ফেরার দীর্ঘ পথ। / আর যাপনের অনুপযোগী এক অসহনীয় আয়ুষ্কাল। / তুমি তো জানো তোমার কাছে পৌঁছুনোর পথ বা গন্তব্য সম্বন্ধে

আমার কোনো ধারণা নেই। / শুধু জানি তুমি সেখানে আছো। / আমার পরমাত্মীয়। আমার পরিসমাপ্তির বিশ্রাম’।

ঋণঃ  বাঁধন চৌধুরী

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*