অণুগল্প – অন্ধকার

দীপক আঢ্য –
বৈশাখী বিকেলে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার প্রচেষ্টা। তার থেকেও ভালো ক’রে বলতে গেলে নির্ভেজাল ঘুরতে যাওয়ার জন্যে বের হওয়া। দুটো মোটর বাইকে চার জন। একটাতে বাবা-ছেলে– অম্লান আর আট বছরের শাওন, অপরটাতে শেখর আর আমি।

হাসনাবাদ ষ্টেশনের পিছনে ডানদিক বরাবর পথ। বাঁক নিলেই বাঁ দিক বরাবর ইছামতী। গ্রামের ধারদিয়ে দূর আরও দূর এগিয়ে গেলে ইছামতী কোন ফাঁকে যে পিছনে পড়ে যায় বোঝা দুষ্কর। আরও কিছুদূর এগিয়ে গেলে ডানদিকে ইট ভাঁটা। সারিসারি সেট- ঘর। বাঁদিকে বাবলা, গোলপাতা, শিয়ালকাঁটার সারি দেওয়া জঙ্গল।

অনেকটা পথ এগিয়ে যেতেই শেখরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস বলতো? আর কত দূর?’ — একথা বলতেই ঝপ ক’রে বাইক থামালো শেখর। শুধু বলল, ‘চলো’।

পিচ রাস্তা থেকে দু’হাত নীচে সমতলে হাঁটতে লাগল সে। অন্ধের মতো আমরাও তাকে অনুসরণ করে রাস্তার পাশের ঝোপ পার হয়ে দু’পা এগিয়ে যেতেই নদীর অপরূপ সৌন্দর্য — ত্রিবেণী সঙ্গম। মোহনপুর। একদিকে ডাঁশানদী, অপরদিকে ইছামতী আর একদিকে বেতনীনদীর ধারা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিকে তাকিয়ে থেকে মনেমনে নয় স্পষ্ট শব্দ উচ্চারণে শেখরকে কুর্নিশ জানালো অম্লান। লাফাতে লাফাতে নদীর জল ছুঁয়ে শাওন পরখ করতে চাইলো তার শীতলতা।

প্রায় ঘণ্টাখানিক কাটিয়ে রাস্তার পাড়ে আসতেই কে যেন হাত ইশারায় ডাকতে লাগল আমাকে। এগিয়ে যেতেই চিনতে অসুবিধা হ’লনা, লোকটি ভূপেন মণ্ডল। এককালে আমাদের পাড়াতেই ভাড়া থাকতো। পেশায় ভ্যান চালক। –‘কেমন আছো ভূপেনকাকা?’ বলতেই আঙুল দিয়ে নদীর পাড়ের চালাহীন বাড়িটার দিকে ইঙ্গিত করল। এতক্ষণে প্রাকৃতিক শোভার আকর্ষণে খেয়ালই করিনি বাড়িটার মাথা খাঁ খাঁ করছে। পাশের ইলেকট্রিক পোস্টটাও উপড়ে পড়ে আছে মাটিতে। পশ্চিমি সূর্যের হেলে পড়া আলোয় ঘরের ভিতরের জামাকাপড়, আসবাব, দেওয়ালের ক্যালেন্ডার সবই সুস্পষ্ট।

— কবে হ’ল এমন? কীভাবে?
পাশের লোকটা করুণ স্বরে বলল, ‘কালই। রাত্রের হঠাৎ ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড। ভূপেনদাদারা প্রাণে বেঁচে গেছে এই যা।’

সন্ধে হ’য়ে যাচ্ছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। কেবলমাত্র বললাম, ‘সাবধানে থেকো।’ একবার ভাবলাম শতখানেক টাকা দিই। সাহায্য বাবদ। মুহূর্তে যেচে উপকার করার বিড়ম্বনার কথা ভেবে চুপ থাকলাম। এমনিতেই ক’দিন পরেই পঞ্চায়েত ভোট। উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে প্রতি মোড়ে মোড়ে। অগত্যা…

এদিকওদিক আরও ঘণ্টাখানিক ঘোরাঘুরি ক’রে যখন টাকির থুবার মোড়ে এসে পৌছুলাম তখন হঠাৎ লোডশেডিং। চারিদিকে অন্ধকার আরও গাঢ় হ’য়ে উঠেছে। তারই মধ্যে ছায়ামূর্তির মতো এক ভ্যানওয়ালা রাস্তার ধারে রাখা সব্জির ঝুড়ি একের পর এক নিজের ভ্যানে তুলতে লাগল। ঝুড়িগুলোর মালিক ঝুড়িগুলো তোলা হতেই বলল, ‘একটু দাঁড়িয়ে যাও। এত অন্ধকারে তুমি যাবে কী ক’রে?’

লোকটা ভ্যানের প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে বলল, ‘হঠাৎ ঘরের চাল উড়ে গেলে দিনের আলোতেও যে অন্ধকার লাগে, দাদা!’

তার গলার স্বর মুহূর্তে আমার নির্ভুলভাবে উপলব্ধ হতেই আমি শেখরকে বললাম, ‘চল্ না।, আমরা এই ভ্যানটার পিছনে পিছনে যাই। অন্তত যতক্ষণ না ইলেকট্রিক আসে।’

ভূপেনকাকার জন্যে মনটা বিষাদ হ’য়ে এল। চতুর্দিকে কত উন্নয়ন। তবুও ভূপেনকাকাদের আলোর কত অভাব!

শেখরের মোটরবাইকের আলোয় সামনের ভ্যানটা চলছে আরও দ্রুত গতিতে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*