আড্ডাপ্রিয় বাঙালির নতুন ঠিকানা হয়ে উঠছে নিউ টাউন

Spread the love

মিতালী মিত্র : কলকাতার গায়ে হেলান দিয়ে গড়ে উঠছে নিউ টাউন। এখনও ভাঙা-গড়া চলছে, পরিকল্পিতভাবে আড়ে বহরে বাড়ছে এই নতুন জনপদ। প্রবাসীদের কাছে মেট্রো সিটির হট্টগোলের পাশেই নিউ টাউন প্রকৃতির কোলে এক সবুজ শহর— হ্যাপি সিটি। কৃষ্টি ও সংস্কৃতির চর্চ্চাতেও কয়েক কদম এগিয়ে রয়েছেন নিউ টাউনের বাসিন্দারা। কলকাতার রবীন্দ্র সদন-নন্দন চত্বর বা কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার আড্ডার পরিবেবশটাই যেন হুবহু উঠে এসেছে এখানে। ইংরেজি বছরের শেষে বইমেলাকে কেন্দ্র করে এখানে নক্ষত্র সমাবেশ হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরেই। আর ১৪২৪ বাংলা বছরের প্রথম দিনের জলসার মধ্য দিয়ে নব আনন্দে মেতে উঠলেন মানুষ। জনপদের ইতিহাস তো এভাবেই গড়ে ওঠে।

আড্ডাপ্রিয় বাঙালির নতুন ঠিকানা হয়ে উঠছে নিউ টাউন- অস্তরবির আলো মিলিয়ে রাত নামে মেট্রো সিটিতে, সাঁঝ ঘনিয়ে আসে নিউ টাউনেও। জমে ওঠে আড্ডা কলকাতায়, নিউ টাউনেও… আইটি সেক্টরের কাজের শেষে ব্যাকপ্যাক কাঁধে তরুণ তরুণীর ঝাঁক বাহারি আলোর নীচে রাস্তার ধাপে বসে আড্ডায় মেতে ওঠে। চলন্ত বাস থেকে তাদের দেখে হয়ত টুপটাপ নেমেও পড়ে বন্ধুরা… আড্ডার টানে। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের ভেতরে কি প্রেসিডেন্সির রেলিং-এ হেলান দেওয়া আড্ডাধারীদের সঙ্গে এদের খুব পার্থক্য থাকে কি, থাকে না। রবীন্দ্র সদন চত্বরে সাংস্কৃতিক শিল্পীদের যে আড্ডার ছবি দেখে আমরা অভ্যস্ত, এখানে নজরুল তীর্থ, রবীন্দ্রতীর্থ, প্রকৃতিতীর্থর সবুজের মাঝে তারই যেন কিছু ছবি দেখা যায়। আড্ডা গড়িয়ে চলে… নিউ টাউনের দিকে দিগন্তে।

এতো গেল রোজকার গল্প। আড্ডার ধরণে মিল রয়েছে নববর্ষে বইপাড়ার বিশেষ  আড্ডার সঙ্গেও। পয়লা বৈশাখে বইপাড়ার আড্ডার মেজাজটাই যেন পাওয়া যাচ্ছে নিউ টাউনে। নিউ টাউন বইমেলা কমিটির আয়োজনে নববর্ষে বৈঠকি আড্ডাও বসে এখানে।

পয়লা বৈশাখে কলেজ স্ট্রিটে বইপাড়ার আড্ডায় গোড়ার দিকে ভিয়েন বসিয়ে রান্না হত। নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে হালখাতা করতেন কাগজ ব্যবসায়ীরা.. সারা বছরের কাগজের দামের হিসেব মিটিয়ে প্রকাশকরা নিমন্ত্রণ খেয়ে নিজের নিজের দোকানমুখী হতেন। সেখানেও হিসেবের খাতার বড়ো ভূমিকা থাকত। বছরভর বই বিক্রির উপর লেখকের রয়্যালটি বুঝিয়ে দিতে হত। সে নিয়ে নানা রসিকতা চালু আছে। তবে এই নববর্ষের আড্ডার টানে, আসতেন অনেকেই। এক এক সময় প্রকাশকের ছোটো ঘরে লোক ধরত না, সামিয়ানা খাটিয়ে নিমন্ত্রিতদের বসিয়ে খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল। মজার ব্যাপার লেখককে অনেক নিমন্ত্রণ রাখতে হত বলে, ছাঁদা বেঁধে নিয়ে যাওয়ারও ব্যবস্থা থাকত। কেউ তাতে কিছু মনে করতেন না। এই খাদ্য তালিকায় দোকানে দোকানে বৈচিত্র্য থাকলেও, একটা কমন ব্যাপার থাকতই-ডাবের জল এবং জলভরা তালশাঁস সন্দেশ। কোল্ডড্রিঙ্কসের রমরমার এই যুগেও পয়লা বৈশাখে ঐতিহ্য বজায় রাখে ডাবের জল আর তালশাঁস সন্দেশই।

লেখকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে ওঠে নববর্ষের আড্ডায়। শুধু লেখককে চোখে দেখতে সকাল থেকে ভিড় জমান পাঠকরা। সই শিকারির কবলে পড়ে নাস্তানাবুদ হতে দেখেছি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, তারাপদ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। মিত্র ঘোষ, দে’জ, আনন্দ, পত্রভারতী, এম সি সরকার এরা ছাড়াও বহু প্রকাশক নববর্ষে আমন্ত্রণ জানান লেখকদের। এখন অবশ্য আর সবুজ খামে কড়কড়ে নোট বা ব্যাঙ্কের চেক মেলে না। কারণ, অডিট মেনে প্রকাশকদের হিসেব মেটাতে হয় ৩১ মার্চ। নববর্ষের আড্ডায় রঙিন খাম নিয়ে লেখকদের সরস মন্তব্য আর শোনা যায় না, তবু আড্ডায় রসের ঘাটতি হয় না।  ছোটো ঘরে বসার জায়গা হয় না, কিন্তু আনন্দ রসের কোনও অভাব থাকে না। হয়ত দেখা গেল, মাটিতে থাকে থাকে সারবন্দি রাখা বইয়ের স্ট্যাগের ওপরেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে আড্ডা দিচ্ছেন বাংলার সেরা লেখককুল। কলেজ স্ট্রিটের আড্ডার একজন মধ্যমণী ছিলেন শরৎ পণ্ডিত, মানে দাদাঠাকুর। নিজে জঙ্গিপুরে তিনি একটি কাগজ চালাতেন। শুনেছি, এক নববর্ষে কাগজের দাম মিটিয়ে সেথান থেকে খাবার-দাবার ছাঁদা বেঁধে নিয়ে সটান হাজির মিত্র ঘোষে। দাদাঠাকুরকে দেখে যাঁরা চলে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিলেন, তাঁরাও বসে পড়লেন আড্ডার লোভে। এরপরই দাদাঠাকুর সকলের অনুরোধে গান ধরলেন- কইলকাতা কেবল ভুলে ভরা…

কালিদাস রায়, কমলকুমার মুখোপাধ্যায়, বিমল কর, অন্নদাশঙ্কর রায়, বুদ্ধদেব বসু, সমরেশ বসু, আশাপূর্ণা দেবী, লীলা মজুমদার সকলেই ছিলেন নববর্ষের আড্ডার তারকা। মিত্র ঘোষের অন্যতম কর্ণধার ভানুদা অর্থাৎ সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের কাছে শুনেছি, সেকালে মূলত দুটি আড্ডা জমত, লেখকরা নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছিলেন, একটু প্রবীণদের ছিল হাউস অব লর্ডস এবং কমবয়সিরা জমা হতেন হাউস অব কমন্সে। অবশ্য এদিক থেকে ওদিকে যাতায়াত চলতই। আড্ডাধারীরা দু-জায়গাতেই জাঁকিয়ে বসতেন। এখন যেমন বইপাড়ার আড্ডায় আলো ছড়ান প্রবীণ ও নবীনে মিলেমিশেই সমরেশ মজুমদার, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, নবণীতা দেবসেন, প্রচেত গুপ্ত, বিনতা রায়চৌধুরী প্রমূখ।

আবার ফিরে আসা যাক নিউ টাউনে। এখানে আড্ডার মেজাজে পাওয়া যায় বিনোদ ঘোষাল, অখিল গিরি প্রমুখ লেখকদের। নিউ টাউন বইমেলা কমিটির আহ্বানে বাংলাদেশ থেকেও কবি ও গল্পকারদের বইমেলার সময়ে আড্ডা জমাতে দেখেছি। শুধু বইমেলার কয়েকটা দিন অথবা নতুন বছরের উতসব নয়, নিউ টাউন জুড়েই গড়ে উঠছে আড্ডার নানান ঠেক। সেখানে যোগ দেন সংগীতশিল্পী, কবি, নাট্যকার, মঞ্চাভিনেতা সকলেই। এসব দেখেই মাঝে মাঝে ধন্দ লাগে— আছি কোথায়- কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় নাকি নিউ টাউনে। এ বছর পয়লা এপ্রিল একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিক সংবাদপত্রের রবিবারের পাতায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল- কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের অনুকরণে নিউ টাউনে ও তৈরি হচ্ছে বইপাড়া… ইত্যাদি ইত্যাদি। খবরটির পরিবেশনার গুণে অনেকেই এতে উত্সাহী হয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন। ওই কাগজেই ছোটো করে লেখা ছিল— পাঠকদের জন্য এটি তাদের এপ্রিল ফুল। পাঠকরা কী কতটা বুঝেছেন জানা নেই, কিন্তু আশার আলো দেখছেন নিউ টাউনবাসী। সত্যিই তো কলেজ স্ট্রিটের মত হেরিটেজ ভবন না থাকলেও, এখানে রয়েছে উন্মুক্ত আকাশের নীচে সবুজ প্রান্তর, রয়েছে একাধিক উন্নত মানের সভাঘর। এই জনপদের বাসিন্দা বহু গুণীজন বছরভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন এখানে। তাই এপ্রিল ফুল নয়, সত্যি সত্যিই নিউটাউন প্রাঙ্গণই হয়ে উঠবে বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভরকেন্দ্র। অপেক্ষা মাত্র আর কয়েকটি বছরের।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*