শীতকালের আস্বাদ

তপন মল্লিক চৌধুরী

প্রথম পর্ব

খাদ্যপ্রেমীদের জিবে কি ঋতুচক্র চলে ? হয়ত তারা নিজেরাও ঠিক ঠাওর পাননা । সারা বছরই তো নিত্য নতুন স্বাদের অনুসন্ধানে লকলকে জিব লালায় ভিজে থাকে, গ্রীষ্ম-বর্ষার আসা যাওয়ায় তেমন একটা হেরফের ঘটে না । তবে শীত আসতেই খাই খাই ভাবটা খুবই হয় । কারণ ঠাণ্ডায় কিছু খাবারদাবার যে জমে দারুণ । শীতকালে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে পেটুক আর পেট পাতলাদের মধ্যে বিশেষ তারতম্যও লক্ষ্য করা যায় না । লেপের ওম আর কমলালেবু রোদের আমেজে যে খাবারগুলি খুব সাধারণ হলেও জিবে পেতে খুব ইচ্ছে করে তারমধ্যে বেশ কয়েকটি খাবারের ফিরিস্তি দেওয়া হল রোজদিন-এর পাতায় ।

গরম কফি- সারা বছরই চলে, এক কাপ কফিতে কেঊ ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে চাঙ্গা হয়ে ওঠেন, কারও কাছে এক কাপ কফি মানে অবসাদ ভুলে নতুন করে শুরু । কফির রকমফেরও নানাবিধ; হট, কোল্ড…একেকজন একেকভাবে গ্রহণ করেন । তবে শীতের সকাল কিম্বা সন্ধ্যে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ কফির আমেজটাই আলাদা । মাগ হাতে কফি নিয়ে শীতকালের দিন শুরু হওয়াটা যেন একটা নতুন স্যুরিয়্যালিস্ট ছবি । ঠাণ্ডার দিনে কফির কদরও অনেক বেশি । শীতের আকাশ থেকে ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে এলে এক কাপ কফির ইচ্ছে আরও ঘন হয় ।

কেক পেস্ট্রি- সারা বছরই কেক-পেস্ট্রি চলে তবে শীতের দিনে ক্রিসমাস বা বড়দিন উপলক্ষে যে কেক আর পেস্ট্রি তৈরি হয়, দোকানগুলি নানা যত স্বাদ-গন্ধ-বর্ণময় কেকের সম্ভারে সেজে ওঠে তেমনটা তো আর সারা বছর মেলে না তাই এই সময়ে ফ্রুট কিম্বা পাল্ম কেকের জন্য মনটা আকুলি বিকুলি করতে থাকে । তাছাড়া শীতের সকাল সন্ধ্যগুলো ওইসব কেক ছাড়া ভাবা যায় না । বছরের অন্যদিনগুলিতে কেক আর ঠাণ্ডার দিনে কেকের আস্বাদ তফাৎ আছে তো বটেই । বছর শেষের দিন থেকে নতুন বছরের গোড়ার দিনগুলিতে কেক আর পেস্ট্রি শুধু আস্বাদ নয় খাদ্য সংস্কৃতির ঐতিহ্য ।

কমলালেবু- মহার্গ এই ফলটি সারা বছর মেলে না, মিললেও শীতের ঠাণ্ডায় তার যে স্বাদ তা অন্য সময় থাকে না । কমলালেবুর সঙ্গে দার্জিলিং নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকলেও নাসিক, ভুটান ফলনে কম যায় না । সেগুলির স্বাদও বিলক্ষ্ণণ, আমরা নাসিক, ভুটানের কমলালেবুর কোয়া মুখে তুলে নিচ্ছি বহুকাল থেকেই । ভুটান সংলগ্ন উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি অঞ্চলের কমলালেবুও আমদের হাতে এসে পৌঁছাচ্ছে, সেগুলিও আমাদের চাহিদা মেটাচ্ছে । মোটকথা শীতের দুপুরে ছাদে কিম্বা বাগানে রোদ পিঠে নিয়ে কমলালেবুর খোসা ছাড়ানোর কী যে সুখ তা বলে বোঝানো সম্ভব নয় ।

ফুলকপির শিঙারা- সারা বছরই চা,মুড়ির সঙ্গে আছে, এমনিএমনিও চলে । মুখরোচক শিঙাড়া তা নিয়ে কী আর বেশি কথা চলে; গরম, হাতে গরম যেমনই হোক না কেন কার বুকের পাতা আছে যে সামনে এনে দিলে না বলবে । সত্যি তাকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না । তবে ময়দার প্যাচালো খোলোসের ভিতরে ফুলকপির মাখোমাখো পুর সে তো আর বৃষ্টির সন্ধ্যেবেলায় চাইলেই মিলবে না, সে তো কেবল শীতের জন্য; বাকি দিনগুলিতে চলে স্রেফ আলুর পুরে । বেরসিকজন বলে থাকেন কড়াইশুটিও এখন মে-জুন মাসে মেলে । কিন্তু তাদের কথা খুবই পানসে ফুলকপির শিঙাড়ার কাছে । কারণ পাড়ার অনামি দকানের স্বাদও দুর্দান্ত ।

কড়াইশুটির কচুরি- ডাল কিম্বা ছাতুর পুরে সারাবছর রসনা মিটে যায় কিন্তু শীতকাল এলে আর কিছুতেই মন ভরতে চায় না । কারণ ঠাণ্ডাঠাণ্ডা কুলকুল দিনে কড়াইশুটির কচুরি ছাড়া কোনও আড্ডা-মজলিস কিছুই জমবে না । গরম কচুরির ঊপরের পাতলা অংশের মধ্যে দিয়ে সবুজ সবুজ পুর দেখা যাবে তবেই না মনে হবে লেপ-কাঁথা মুড়ি দেওয়া দিনের আরাম । পরম আস্বাদের কড়াইশুটির কচুরির সঙ্গে কিন্তু গা জড়াজড়ি করে থাকে নতুন আলুর দম । কারণ ওই বস্তুটিও সারা বছর মাথা মুড়িয়ে ফেললেও মিলবে না । আকারে ছোট হলে কী হবে স্বাদে একেবারে ফাটাফাটি । ঝালঝাল নতুন আলুর দম আর কড়াইশুটির কচুরি শীতের ঠাণ্ডায় যাকে বলে রাজযোটক । তবে এ কথা বলতেই হবে নতুন আলুর দমের সঙ্গে শুধু কড়াইশুটির কচুরি নয় লুচি, পরোটা নিদেনপক্ষে গরম হাতে রুটিও এককথায় অসাধারণ । যেমন শুধু নতুন আলুর দম নয় কড়াইশুটির কচুরি জমে যায় ঝিরিঝিরি আলুভাজার সঙ্গেও ।

নলেন গুড়- শীতকালের গুঢ় বিষয় যে নলেন গুড় সে ব্যাপারে সব্বাই একমত । শিঊলির হাত ধরে খেজুর গাছ থেকে নেমে আসা হাঁড়িভরা রস সামান্য জ্বালের পর যে কী জিনিসে পরিণত হয় সে তো আর কথায় বোঝানো যায় না, তার দরকারই বা কী । সন্দেশ, রসগোল্লা, পায়েশ, পাটিসাপটা কি-না হয় নতুন গুড়ে, আর প্রতিটি পদ তো এক সে বড়কর এক, কাকে বাদ দেব আর কাকে রাখব ঠিক করতে যাওয়াটা বোকামি । নলেন গুড়ের এমনই জাদু পিঠে-পায়েস-মিষ্টি যদি নাও মেলে তো রুটি দিয়ে খান; পাউরুটি চুবিয়ে নিলে তো…

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*