শীতের আস্বাদ

A group of delicious and famous Pakistani and Indian Sweets

তপন মল্লিক চৌধুরী

দ্বিতীয় পর্ব

খাদ্যরসিকদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই আছেন যারা মিষ্টি পছন্দ করেন না, অধিকাংশই মিষ্টির ভক্ত, এদের জন্য শীতকাল তো পরম প্রিয় সময় । শীতের সময়েই মেলে নলেন গুড়, সেই গুড়ের পিঠে-পায়েস আর মিষ্টির স্বাদ মনে করলেই জিবে জল চলে আসে । ভাপা, পুলি, চিতই-এর মতো বাহারি নামের পিঠে যেমন তেমনই নলেন গুড়ের তালশাস আর রসগোল্লা । আজকাল পিঠে আর আগের মত করে বড়িতে তৈরি হয় না, তাতে অবশ্য পিঠে কিম্বা পায়েসের কদর একটুও কমে যায়নি বরং একটু বেড়েছে । শীত পড়তেই শহরের নামি অনামি সব মিষ্টির দোকানেই সন্দেশ রসগোল্লার পাশাপাশি রকমারি পিঠে পুলির শোভা লক্ষ্য করা যায় ।

 

নলেন গুড়ের সন্দেশ– নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই মিষ্টিপ্রেমীরা জিব আকুলি বিকুলি করতে থাকে নলেন গুড়ের সন্দেশের জন্য । এরকমটা বললেও মনে হয় ভুল হয় না যে বছরের অন্য সময়টা যেন তারা হাপিত্যেশ করে থাকেন এই শীতকালের জন্য । সারা বছর যেমন শীত থাকে না, থাকে না খেজুর রস কিম্বা নলেন গুড়, তাহলে আর কীভাবে হবে সেই গুড়ের স্বাদে গন্ধেভরা সন্দেশ-রসগোল্লা । তবে সন্দেশের ক্ষেত্রে নরম আর কড়া পাক নিয়ে সামান্য হলেও বিভাজন আছেই । তা বলে কি মিষ্টির দোকানের ট্রে-গুলো ফাঁকা পড়ে থাকে নরম কড়া কোথা দিয়ে যে উড়ে যায় দোকানদার বাবুই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেন না । রসগোল্লার ক্ষেত্রেও ওই একই কথা । সাদা রসগোল্লা হলে অধিকাংশরাই রস চিপে খান আর নলেন গুড়ের হলে তো রসটুকুও চেটেপুটে সাবার করে দেন । কেউ কেউ আবার একটু অতিরিক্ত রসের আবদারও করেন ।

 

নতুন গুড়ের পায়েস– আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা আছেই, তবু এখনো নিয়ম করে নভেম্বর থেকে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত যেকটি খেজুর গাছ অবশিষ্ট আছে তাতে হাঁড়ি ঝলে, হাঁড়ি রসে ভরে । হেমন্তের পর ধীরে ধীরে তাপমাত্রা যত কমে তত মিষ্টত্ব বাড়ে খেজুর গাছের ফ্লোয়েম কোষে; একই সঙ্গে খেজুর গাছের কোষে আর একটি বিশেষ রূপান্তর ঘটে যার ফলে সুগন্ধে ভরে যায় রস । এই সময় রসের পরিমাণও বাড়ে । সারা বছরই নানান সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে পুজো-আচ্চাদিতে চিনির পায়েস হয়েই থাকে । কিন্তু বছরের এই সময়টা পায়েস মানেই নতুন গুড় বা পাটালি দিয়ে তৈরি কোরা আভাময় পায়েস । কী যে তার স্বাদ আর তেমনই তার সুমিষ্ট গন্ধ । বছর শুরু হওয়ার দিনে নতুন গুড় বা পাটালির পায়েস মুখে না নিলে সারা বছরই যেন মুখ তেতো মেরে থাকে ।

 

ভাপা-পুলি-পাটিসাপ্টা- চালবাটা দিয়ে তৈরি পাতলা আস্তরনের মধ্যে নারকেলের পুর; সেই পুর সাধারণত মিষ্টিই হয়, অনেকটা নাড়কেল নাড়ুর পুরের মতোই তবে তাতে চিনির মিষ্টির চলই বেশি । কিন্তু শীতের পিঠের পুর বিশেষ করে পাটিসাপটা নলেন বা পাটালি ছাড়া ভাবা যায় না । মুখে দিলেই ম্যাজিকের মতো ক্রীয়াকর্ম ঘটতে থাকে যা কয়েক নিমেষ অনুভব করা যায় । ওই যে ম্যাজিক কিম্বা বিশেষ অনুভূতিময় মুহূর্তগুলি তার পিছনে একজনের ভুমিকাই উচ্চমার্গে কাজ করে সে হল শীতের নতুন গুড়, তাকে বাদ দিয়ে শীতের কোনও পিঠের কথা ভাবাই যায় না । আজকাল দোকানে বাজারে সর্বত্রই মেলে পিঠে পায়েস কিন্তু মাসিমা-কাকিমা-দিদিমা-ঠাকুমার হাতের পরশে যে অভিনবত্ব তা কি আর দোকান বাজারে পয়সা দিয়ে মেলে…

 

জয়নগরের মোয়া– কে জানে মোয়া নামটি কোথা থেকে কীভাবে এল, শুধু যে এল তা তো নয় জড়িয়ে গেল আমাদের খাদ্য যাপনের পরতে পরতে । চিড়ে, মুড়ি, খই ইত্যাদির মোয়া তো যে কোনও পুজোর প্রসাদ হিসেবে কমন পড়েই যায়, তাছাড়া এখনো যেসব বাড়িতে দিদিমা ঠাকুমারা রয়ে গেছেন তারা পরিবারের মানুষদের মুখে ভালবেসে তুলে দেন তাঁদের হাতে পাকানো মোয়া । কিন্তু শীতকালে জয়নগরের মোয়া জিনিসটির কথাই আলাদা—কণকচূড় ধানের খই থেকে তৈরি মুড়কি দিয়ে পাকানো গোল্লাগুলির স্বাদ এবং সেটি মুখের মধ্যে আলগাভাবে ভেঙে যাবার পর যে গন্ধ তা বর্ণনার অতীত । স্টেশন টারমিনারস থেকে বাজার হাট, অলিগলির দোকানপাট সর্বত্রই শীতের দিনে মেলে জয়নগরের মোয়া বিক্রি হয় রমরম করে, সব প্যাকেটেই জয়নগর উল্লেখ থাকে ঠিকই কিন্তু কৌলীন্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বেশ কিছুদিন ধরে । আসল নকল সব প্রশ্নের পরও শীতের দিন জয়নগরের মোয়া ছাড়া ভাবা যায় না ।

 

রেড ওয়াইন– ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার সেলিব্রেশান, পিকনিক এসবই তো শীতকালেরই ঘটনা, কিন্তু রেড ওয়াইন ছাড়া কি শীতকালের উল্লাস উদযাপন সম্পূর্ণ হতে পারে ? অসম্ভব । কেবল বর্ষশেষ কিম্বা নতুন বছর শুরুর হইহুল্লোর তো নয় বনফায়ার-হাউসপার্টি কোনও কিছুই জমবে না রেড ওয়াইন বাদ রেখে । পার্টি যারা পছন্দ করেন না একটু নিরালা নির্জনতাই যাদের স্বভাবজাত অভ্যাস তারাও শীতের রাতে লেপের আদরের সঙ্গে হাতে ধরেন এক গ্লাস রেড ওয়াইন আর পছন্দের নভেল অথবা সিনেমা । মেজাজটাও যেমন খোলতাই হয়ে যায় তেমনই ঘুমটাও হয় গাঢ় । পরের দিন ফুরফুরে মেজাজ বলে ওঠে এই না হলে শীতকাল।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*