বই চোর

তপন মল্লিক চৌধুরী

বুক থিফ নামে একটি ঊপন্যাস কয়েক বছর আগে বেশ সারা ফেলেছিল দুনিয়ার পাঠক মহলে । রচনাকার মারকুস জুসাক তাঁর ওই ঊপন্যাসের জন্য সেই সময় যথেষ্ট খ্যাতিও অর্জন করেছিলেন তবে আজ তাঁর কথা তেমন করে আর কারও স্মরণে নেই। কিন্তু ২০০৫ সালে বুক থিফ যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তার পরেই সারা দুনিয়ার পাঠককুল তাঁর ওই উপন্যাস নিয়ে হইচই শুরু করে দেয়। কেবল তাই নয় ওই বইয়ের বিষয়ভাবনা থেকে শুরু করে তার বিক্রি সবই শীর্ষস্থান অধিকার করে। মারকুস জুসাকের বুক থিফ আজও সেই জায়গাটতেই রয়ে গেছে কিন্তু পাঠক কি সেই আখ্যান মনে রেখেছে ?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন জার্মানিতে যখন নাৎসি বাহিনী নিপীড়নের চরম ভয়াবহতা আর ধ্বংসলীলায় আপামর জনগণমনে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে ঠিক সেই সময়কার একটি অভাবনীয় ঘটনাকে তুলে ধরেন জুসাক তাঁর বুক থিফ-এ। আমরা মুখোমুখি হই লিসেল নামে এক কিশোরীর ঊদ্বেগতাড়িত অসহনীয় জীবনযাপনের সঙ্গে, তখন সে তার ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বিপন্ন বিপর্যস্ত ও বিধ্বংস তবু মৃত্যু আর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকেও যে জীবনের স্বপ্ন দেখা সম্ভব সেই নিশ্চিত অসম্ভবকে আমরা দেখতে পেলাম লিসেল-এর মধ্যে। বই পড়ার মধ্যে সে ক্রমশই খুঁজে পেতে থাকে বেঁচে থাকার উৎসাহ, ক্রমশই তাকে ভিড় করতে থাকে বই, বিভিন্ন বইয়ের পাতায় পাতায় সে যেন খুঁজে পেতে থাকে আশ্চর্য থেকে অতি আশ্চর্যময় রত্ন সামগ্রী । বই-এর নেশায় সে মাতাল হয়ে পড়ে কিন্তু এসবই অতি গোপনে, সন্তর্পনে কারণ, দুনিয়ার কোনও নাৎসি, কোনও ফ্যাসিবাদ কখোনোই বই বা তার পাঠকে সুনজরে দেখে না। একটি বইয়ের মধ্যেই থাকে বিপ্লবের বারুদ, একটি বইয়ের মধ্যেই থাকে আগুন শিখা, তাই নাৎসি জমানায় বই-এর ঠাঁই নেই। কিশোরী লেসলিও জেনেবুঝে ফেলেছিল সেকথা কিন্তু বই পড়ার গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারলেও লেসলি শেষ পর্যন্ত হয়ে ঊঠল একজন বই চোর। লেসলিকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে নাৎসিরা, কোথায় লেসলি, কোন গোপন আস্তানায় সে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। নাৎসিদের তো লেসলিকে খুঁজে পেতেই হবে, তবে যত না বই চোর লেসলিকে তার চেয়ে অনেক বেশি যে, চুরি করে নাৎসিদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চায় সেই বই যার পাতায় পাতায় বারুদ ঠাসা, ছত্রে ছত্রে আগুনের শিখা। কারণ লেসলির মতো বই চোরেরাই পারে সভ্যতাকে ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে।

বই চোরদের আমরা বিখ্যাত কিম্বা কুখ্যাত যাই বলি না কেন তাদের কান্ডকারখানা নিয়ে সারা দুনিয়াজুড়েই নানা গল্পকথার ছড়াছড়ি। কালেদিনে সেসব গল্পকথা দেশে বিদেশে নানা রঙে রূপ পেয়েছে। মনে পড়ছে মার্কিন দেশের এক বিখ্যাত বা অখ্যাত বই চোর-এর কথা, তার নাম ছিল স্টেফান ব্লুমবারগ। এই বই চোর তিরিশ বছর ধরে বই চুরি করে প্রায় তেইশ হাজার বই-এর মালিক হয়েছিলেন। স্টেফানের চুরি করা বইগুলির সর্বমোট মুল্য দাঁড়িয়েছিল প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডলার, কিন্তু স্টেফান কখোনো চুরি করা বই বিক্রি করতে আগ্রহী ছিল না, সে মনোযোগী ছিল বই পড়াতে। সে বই চুরি করত, বই সযন্তে রাখত এবং পড়ত। বিভিন্ন গ্রন্থাগার, বইয়ের দোকান থেকে ওই বিপুল সংখ্যক বই চুরি করে সংগ্রহের জন্য সে যুক্তি দিয়েছিল যে সে মুল্যবান বইগুলিকে বাঁচিয়ে রেখে পৃথিবীর সভ্যতাকেই বাঁচিয়ে রাখার কাজ করেছে। আমরা স্টেফান ব্লুম্ববারগকে কি বই চোর বলব, না কি অন্য কথা ভাববো?

স্টেফান ব্লুম্ববার্গ-এর পর ঊল্লেখ করা যায় ব্রিটিস বই চোর ঊইলিয়াম জোকসের নাম । এই বই চোর নিজের জন্য ছন্মনামও নিয়েছিল—টম রেইডার। জোকস বা টম ব্রিটেনের প্রায় সব নামি দামি লাইব্রেরি থেকেই বই হাতিয়েছিল। বই চুরি করার জন্য তাকে দু’দুবার জেল খাটতে হয়েছিল, সেই সময় তার চুরি করা বইয়ের মূল্য হিসাব করে দেখা গেল প্রায় ১৫০ মিলিয়ন পাঊন্ড। সম্প্রতি আঞ্চলিক একটি বই মেলায় একজন মহিলা বই চোর ২৯টি বই বিভিন্ন স্টল থেকে চুরি করার পর সন্দেহবশতই ধরা পড়ে যায়, কিন্তু তার মধ্যে কোনও রকম লজ্জাবোধ কিম্বা ভয়ের লক্ষণ না দেখতে পেয়ে বইমেলা কর্তৃপক্ষ এই কাজ সে কেন করেছে জিঙ্গাসা করায় সে স্পষ্ট করে জানায় বই চুরি মহৎ কাজ সে নিজেকে কখোনোই অপরাধী ভাবতে রাজি নয়। কেবল তাই নয় সে একথাও জোর দিয়ে বলে সে ফের এই কাজ করবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*