গল্পঃ রোদ বৃষ্টির খেলা

দীপক আঢ্যঃ

প্রথম যে দিন ‘মিনি সুন্দরবন’ নামটা শুনেছিল, সে দিন একটু অবাকই হয়ে ছিল সন্দীপ। পরে অবশ্য জেনেছিল এটা নামেই সুন্দরবন, আসলে টাকীর সৈয়দপুর গ্রামের শেষ প্রান্তে ইছামতী নদীর চরে কয়েক একর জমির উপর হোগলা পাতা, বান পাতা আর বুনো আব্জা গাছের জঙ্গল। টাকী পৌরসভার নব্য সংযোজন । মুক্ত নির্জন বিপদহীন এলাকা। কেউ যায় কৌতুহলে, কেউ যায় চেনা লোকের আড়াল পেতে।

সন্দীপ কখনো মিনি সুন্দরবনে যায়নি। বসিরহাট থেকে মাত্র কিলোমিটার দশেকের পথ। ইতিপূর্বে যাওয়ার সুযোগও ঘটেনি। কয়েক বার যাব যাব করলেও বন্ধু-বান্ধবের অনুৎসাহে বিষয়টা এগোয়ও নি। যে শোনে সে বলে, কী আছে ওখানে? কী দেখতেই বা যাবি? নদীর ধারে কটা বুনো গাছ!

সহেলী সন্দীপের বাল্য বন্ধু। প্রতিবেশীও। তার থেকে বরাবর দু ক্লাশ ছোট। এবার এস এস সি তে দু জনেই স্কুলে চাকরি পেয়েছে। সহেলী বাড়ির কাছেই ইটিন্ডা গার্লসে, সন্দীপ মধ্যমগ্রাম হাই স্কুল। দু জনের স্কুল দু মাথায়।কাজেই আজকাল দেখা সাক্ষাৎ হয় যথেষ্ট কম। তবুও দু জনের মধ্যে বেশ এক রকম উষ্ণ সম্পর্ক বর্তমান। তথাকথিত ভালোবাসা একে অপরকে প্রকাশ না করলেও সন্দীপ জানে প্রত্যেক দিনের অনেক খানি সময় তার সহেলীর জন্যে বরাদ্দ। তা সে ফেস বুক হোক কিম্বা হোয়াটস্‌ অ্যা্প ।ওদিকে সহেলীর দেওয়া মিসড্‌ কল, এস এম এস, ডি পি তে পরিপূর্ণ তার স্মার্ট ফোন।

এখন গরমের ছুটি। পরীক্ষার খাতা দেখাও নেই। অতএব অখন্ড অবসর।

‘ওই কী করছিস?’ হোয়াটস্‌ অ্যা্পে ম্যাসেজ ঢোকে সন্দীপের।

‘বিশেষ কিছু না।’ রিপ্লাই দেয় সন্দীপ।

‘তাহলে চল না এখন টাকী যাই। মিনি সুন্দরবন দেখতে।’

‘এই দুপুর রদ্দুরে? খেপলি নাকি তুই?’

‘চল না প্লীজ,কথা আছে, এক দম স্পেশাল।’

‘বেশ। রেডি হ। আমি বের হচ্ছি।’ ম্যাসেজ টা লিখতে লিখতে সন্দীপের মনে পড়ল সম্প্রতি কোন এক ফিল্ম স্টারের সাখ্যাতকারে পড়েছে, প্রেম – ভালোবাসা এমনই জিনিস যে বিয়াল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায়ও ছাদের উপরে মিউসিক্যাল চেয়ার খেলার উৎসাহ দেয়। কথাটা মনে পড়তেই নিজের মনে মনে হাসল সন্দীপ।

খা খা রদ্দুরে মোটর বাইকে বের হল সন্দীপ আর সহেলী। রদ্দুরের উত্তাপ আগুনের হলকার মতো এসে ঠেকছে। সহেলী ওড়নাটা ভালো করে মাথা দিয়ে নাক মুখ বেড় দিয়ে আটকে নেয়। মাওবাদীদের মতো কেবল চোখের অংশটা খোলা। রোদের হলকা থেকে বাঁচার এক মাত্র উপায়। বাইক চালাতে চালাতে সন্দীপও নামিয়ে দেয় হেলমেটের গ্লাশ।

প্রায় বছর দশেক পরে টাকীতে পা দিল সন্দীপ। কত বদলে গেছে চার ধার। ইছামতীর বাঁধানো পাড় দিয়ে মোটর বাইকে যেতে যেতে সন্দীপ বলল, ‘এই দুপুরে আমাদের কে কেউ দেখে ফেললেই ভাববে, মাষ্টার আর মাস্টারনি প্রেম করতে বেরিয়েছে।

‘হুঁউউ… ভাবলেই হল!’

‘না তা ভাববে না তো কি? তাহলে কী ভাববে কুত্তায় কামড়িয়েছে বলে অ্যান্টির‍্যাভিস ইঞ্জেকশান দিতে বেরিয়েছে?’

সন্দীপের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে ওঠে সহেলী। সে হাসিতে যোগ দেয় সন্দীপও।

গ্রামের ভিতর দিয়ে বাইক নিয়ে কোথাও পিচ রাস্তা কোথাও ঢালাই রাস্তা বরাবর এগিয়ে যেতে থাকে সন্দীপ। কিছুদূর অন্তর অন্তর বাঁকের কাছে গাছের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট টিনের সাইন বোর্ড দিয়ে পথ নির্দেশ করা ‘ মিনি সুন্দরবন এই পথে।’ ফলত কাউকে জিজ্ঞাসা করতে হলনা মিনি সুন্দরবনের পথ। এগিয়ে যেতে যেতে একটা সরু খালের ধার ঘেঁষে বি এস এফ চৌকি। একই পিচ রাস্তা। সন্দীপের বাইক যেতে দেখে বি এস এফ ক্যম্প থেকে একজন বি এস এফ এগিয়ে এসে ইঙ্গিতে থামতে বলল। ভাঙা বাংলা ও হিন্দি মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবু, কাঁহা যাওগে?’

সন্দীপ মোটর বাইক থামিয়ে উত্তর দিল, ‘মিনি সুন্দরবন।’

-আইকার্ড হ্যায় আপকাপাস্‌? ইহা জমা করনা হ্যায়।

সন্দীপ পার্স থেকে ভোটার আইকার্ড বের করে বি এস এফটির হাতে দিল। বি এস এফ জাওয়ানটি ছক টানা খাতায় সন্দীপের নাম নাম্বার অফ মেল ফিমেল ও এন্ট্রান্সের টাইম লিখে সন্দীপকে বলল, ‘সাইন কর দিজিয়ে।’

রেজিস্ট্রি খাতায় সাইন করে সহেলী কে আবার বাইকের পিছনে নিয়ে এগিয়ে গেল ওরা মিনি সুন্দরবনের দিকে।

ইছামতীর পাড়ে কনক্রিটের প্রায় আত ফুট চওড়া দেড়শ মিটার লম্বা আঁকা বাঁকা ব্রিজ ঢুকে গেছে ম্যানমেড অরন্যে। নীল সাদা রঙের ব্রিজ। উপরে উন্মুক্ত আকাশ। যতদূর চোখ যায় মাঠ বিল আর ধু-ধু শূন্যতা। নদীর পরপারের দীগন্ত ছুঁয়ে রেখেছে আকাশ। সন্দীপ ইছামতীর ওপার দেখিয়ে সহেলীকে বলল, ‘দেখছিস। ওই ওটা বাংলাদেশ।’

‘তাই! কত কাছে অথচ কত দূর!’ বিস্ময়ে বলল সহেলী।

ব্রিজের মুখেও দুজন বিএসএফ নিজেদের মধ্যে কথা বার্তায় মশগুল। ওদের পাশেই মোটর বাইকটাকে স্ট্যান্ড দিয়ে ব্রিজের উপর দিয়ে এগিয়ে গেল সহেলী আর সন্দীপ। অবাক চোখে হাঁ হয়ে ঘ্রান নিচ্ছে সন্দীপ মিনি সুন্দরবনের সবুজের। ব্রিজের প্রায় দশ ফুট নীচে শ্বাসমূলওয়ালা গাছগুলো এঁকে বেঁকে ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে। দু-চারটে নাম না জানা পাখি পাতার আড়ালে লাফালাফি করছে। ব্রিজের শেষ প্রান্তে নীল প্লাস্টিক চাদরে ঢাকা বসার জায়গা। চারিধারে রেলিং দেওয়া। সন্দীপ যেন চলে গিয়েছে আরও সবুজের গভীরে। মুখ দিয়ে একটাই অভিব্যক্তি, ‘কি সুন্দর! অপূর্ব! কি দারুন!’

‘বুঝতেই পারছি তোর খুব ভালো লাগছে। এক দম কবি কবি হয়ে গেছিস মনে হচ্ছে।’ সন্দীপের ছটফটানি দেখে সহেলী বলে।

ঝপাং করে সহেলীর ডান হাতটা নিজের দু হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে সন্দীপ বলে। ‘কেন, ভালো লাগছেনা তোর? আমি তো হেব্বি এনজয় করছি!’

সহেলী সন্দীপের এই হাতের খেলায় আগে থেকেই সড়গড়। যখন ওরা এক সাথে কোচিং নিত তখন আড়াল আবডালে সময় সুযোগ পেলেই কখনো সহেলীর ডান হাত কখনো বাঁ হাত- আঙুলের খেলায় পার করে দিত নীরব সময়। সহেলীও উপভোগ করত সন্দীপের আঙুলের স্পর্শ।

নীরব সময় কিছুক্ষন পার হতেই এবার সন্দীপ সহেলীকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘কি রে, কোথায় ডুবে আছিস? কোন কথা নেই যে তোর!’

ধীরে ধীরে সন্দীপের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় সহেলী।

সন্দীপ হঠাৎ উচ্ছসিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘হ্যাঁ রে, কি একটা বলবি বলছিলি? স্পেশাল? কই বললি না তো?

-হ্যাঁ, সেটাই ভাবছি। ভাবছি বলব কি না?

-হ্যাঁ, বলবি যখন ভাবছিস বলেই ফেল। ফালতু টেনশন দিস না।

কিছুক্ষন চুপ করে থেকে স্মার্ট ফোনটা ব্রাউসিং করতে করতে সহেলী ফোনটা এগিয়ে দেয় সন্দীপকে। বলে, ‘দেখত ছেলেটাকে পছন্দ হয় কিনা?

-কে এ ?

-আর পবন। জন্ম সুত্রে সিন্ধ্রি। কোলকাতায় দু পুরুষের বাস। পি এইচ ডি। গত বছর বরানগর কলেজে ইংলিশের লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে।

-কোথায় পেলি এ কে?

-কোথায় আবার! একটা অন লাইন মেট্রিমোনিয়ালে মেম্বারশিপ নিয়ে আমার প্রোফাইল আপলোড করেছিলাম। ও ইন্টারেস্ট শো করেছে। আমি একসেপ্ট করতেই… গত প্রায় সপ্তা দুয়েক কথা হয়েছে হোয়াটস্‌ অ্যা্পে ।একদম ফর্মাল। দেখবি চ্যাটটা? দেখনা। সন্দীপের সামনে থেকে ফোনটা নিজের কাছে নিয়ে চ্যাট হিষ্ট্রি বের করতে থাকে সহেলী।

মুহূর্তে সন্দীপের বুকের ভিতরটা যেন মুচড়ে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে বক্সিং রিং এ আর পবন নামক কোন এক অজানা অচেনা প্রতিদ্বন্দ্বী এক ঘুষিতে নক আউট করে দিয়েছে তাকে। ভেঙে দিয়েছে মনের গভীরে অকথিত হাজারও স্বপ্ন। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র নীল শেড সমেত বসার জায়গা, চার ধারের গাছপালা, সহেলীর মুখ দুলতে থাকে এক ঝটকায়। দরদর করে ঘামতে থাকে সে। একটা চাপা কান্না চোখের কোন ভেদ করে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। কোন ক্রমে জামার হাতায় নিজের মুখ মুছে অস্ফুট গলায় বলে, ‘বের হবি না,এখান থেকে?’

হঠাৎ সন্দীপের চোখ মুখ চেহারার ভোল পরিবর্তন এড়ায় না সহেলীর চোখ। তবুও প্রায় না দেখার ভান করে অভ্যেশ মতো সন্দীপকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বলে, ‘দেখবিনা চ্যাটটা?’

‘হুঁ পরে। বাড়ি গিয়ে।’ কোন ক্রমে বলে সন্দীপ।

‘কোন কমেন্ট করলি না তো?’

‘পরে জানাবো। ওই দ্যাখ্‌।’ সন্দীপ ডান হাতের তর্জনী দিয়ে দেখায় দূরে পশ্চিমাকাশে জমা হয়েছে ঘন কালো মেঘ। এখানে আসার সময় যে প্রচণ্ড রদ্দুর ছিল এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। চতুর্দিক যেন ছেয়ে এসেছে কালো অন্ধকার হয়ে। ‘এক্ষুনি বৃষ্টি এলে ভেজা ছাড়া আর কোন পথ থাকবেনা। নে, তাড়াতাড়ি চল।’ অস্ফুট গলায় বলে সন্দীপ।

নিঃশব্দের সময় যেন পার হতেই চায় না। ফেরার সময় একই রকম ভাবে বি এস এফ চৌকি থেকে ঝটপট আই কার্ড কেরত নিয়ে সই সাবুদ সেরে মোটর বাইকের গতি বাড়ায় সন্দীপ। ফাঁকা রাস্তা। জোর বাতাস উঠেছে। ঝর উঠেছে যেন সন্দীপের মনেও। সহেলীর মনে হতে থাকে বাতাসের সাথে বাইক নিয়ে পাল্লা দিচ্ছে সন্দীপ। খানিকটা ভয়ে খানিকটা নিজের সুবিধায় দু হাত দিয়ে পিছন দিক থেকে সজোরে জাপটে ধরে সন্দীপের কোমর। দু –এক বার বলে, ‘আস্তে চালা!’ কিন্তু গাড়ির গতি আর ঝোড় বাতাসের আওয়াজে সন্দীপের হেলমেট ভেদ করে সে কথা নিশ্চিত ভাবেই কানে গেল না তার।

পথ অর্ধেক পার হতে না হতেই বৃষ্টি এল ঝেঁপে। বসিরহাট এখনও প্রায় সাত কিলোমিটার। সন্দীপ বাইক স্লো করে জিজ্ঞাসা করল, ‘দাঁড়াবি না এভাবেই বৃষ্টিতে বেরিয়ে যাব?’

‘তোর যেটা বেটার মনে হয় কর।’ উত্তর দেয় সহেলী।

সন্দীপ আগের মতো একই গতিতে চলতে থাকে। মিনিট কয়েকের মধ্যে পৌঁছে যায় বসিরহাট। সহেলীকে ড্রপ করে ফিরে আসে বাড়িতে।

ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হতেই সুর করে বেজে ওঠে সন্দীপের মোবাইল। ম্যাসেজ ঢুকেছে। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও ম্যাসেজ টা খুলল। সহেলী পাঠিয়েছে কমপিউটার থেকে ।প্রথমে একটু অবাকই হল সন্দীপ। স্মার্ট ফোন নেওয়ার পর থেকে আজকাল তো আর কম পিউটার থেকে এস এম এস পাঠায় না! সহেলী লিখেছে, ‘ফেস বুকে আয়। এক্ষুনি। প্লীজ…’

সঙ্গে সঙ্গে আবারও একটা এস এম এস। ‘আমি অপেক্ষা করছি …তোর জন্য। এফ বি তে আয়। তাড়াতাড়ি।’

অগত্যা ফেস বুকে অন হতেই সন্দীপ দেখল ঠিক এক মিনিট আগে সহেলী অফ লাইন হয়ে গিয়েছে। ম্যাসেজ বক্স ক্লিক করতেই সদ্য লিখে যাওয়া কয়েক লাইনের একটা ম্যাসেজ শো করল। সহেলী লিখেছে, ‘তুই বলেছিলি বাড়িতে ফিরে আর পবনের ব্যাপারে কমেন্ট করবি। তোর আর কমেন্ট করতে হবে না। আমি কমেন্ট পেয়ে গিয়েছি রে। আমারও তো চোখ আছে। মন আছে। পড়তেও পারি একটু আদ্দেক। আর পবনের ছবি দেখানোর পর তোর যে ছবি আমি দেখেছি… মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল আমি বুঝি তোকে হারালাম। বাড়ি এসে হোয়াটস্‌অ্যাপে আর পবনকে ব্লক করে দিয়েছি। আমার প্রোফাইলও তুলে নিয়েছি মেট্রিমনিয়াল থেকে। উই হ্যাভ বিন মেন্টালি এনগেজড্‌ বাই গড্‌স ব্লেসিংস। তাই না? আই অ্যাম হ্যাপি। উই আর বোথ ইন লভ……তাই না?’ সন্দীপ ম্যাসেজটা পড়তে পড়তে বারন্দায় চলে এল। কিছুক্ষন আগের গ্লানি হঠা ৎ কোথায় যেন উবে গিয়েছে। এক অব্যক্ত আনন্দে তার দেহ-মন যেন ফুটছে। আবার ম্যাসেজ টা পড়ল। আবারও। ঠিক তখনি বাইরে চোখ যেতেই সন্দীপ দেখতে পেল পশ্চিমাকাশ লাল করে অস্তগামী সূর্যের রঙিন আভা। ঠিকরে পড়েছে পথের পরে রঙিন আলো। সেখানে এতক্ষন হয়ে যাওয়া ঝড়বৃষ্টির চিহ্ন মাত্র নেই।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*