ভালোবাসার রিংটোন

চিত্রলেখা দেঃ

দিদি, আমার আইডিয়া ফোনটা রিচার্জ করে দাও।
দিদি,,এখানে ভোডাফোনের আধার কার্ড লিঙ্ক করা হয় তো?
ও মেয়ে আমার ফোনে একটু পয়সা ভরে দাও তো।
একটা কুড়ি টাকার কার্ড দিন তো।
এটাই আপাততঃ সারাদিন শুনতে এবং করতে হয় সুজাতাকে।শুনে শুনে এমন হয়েছে, অনেক সময় মাকে ভাতের পরিবর্তে ফোন রিচার্জ করতে বলেছে।মা সেলাই ফেলে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছে।
বাবা হঠাত করে মারা যাবার পরই সুজাতা অকূলপাথারে পড়ে মাকে নিয়ে।মায়ের শরীরটা এমনিই রুগ্ন বারোমাস তার ওপর বাবার মৃত্যুর পর আরও ভেঙে পড়েছে।সংসারটা চালাতে হিমসিম খাচ্ছিল সুজাতা,ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর টিউশনির টাকাতে আর কুলানো যাচ্ছিল সংসারের খরচ।তাই মোবাইলের দোকানে কাজটা নিয়েছিল সুজাতা।
“মহামায়া মোবাইল রিপিয়ারিং শপ”,,,দোকানটায় এত ভীড় হয় যে সামলাতে পারে না রনো।ওর হাতের কাজ এতটাই ভালো যে এই তল্লাটে কারোর ফোন খারাপ হলে সবাই রনোর দোকানেই আসে।
ফোন সারাতে গিয়ে ফোন রিচার্জ বা অন্য কাজ গুলি করার সময় পেত না রনো।তাই ওর বোনের পরিচিতা সুজাতাকে এই কাজের জন্য রাখে রনো।প্রথমটা হাতে ধরে কাজ শিখিয়ে দিলেও এখন সব নিজে নিজেই করতে পারে সুজাতা।খুব চটপটে মেয়েটা।
খুব সাধারণ একটা মেয়ে সুজাতা।দুটো চুড়িদারই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরে আসে, চুলে একটা ছোট্ট করে বিনুনি বাঁধা,হাতে একটা সস্তার ঘড়ি।এইটুকুই ওর সাজ।
রনো লক্ষ্য করেছে একটা ছোট এনামেলের কৌটোতে করে মুড়ি আর চানাচুর নিয়ে আসে সুজাতা।রনো কতবার নিজের টিফিন ওকে খেতে বলেছে কিন্ত সুজাতা নেয়নি।বেলার দিকে দোকানে ভীড় একটু কম থাকলে সুজাতা কমদামের সব্জী কিনে আনে ভাঙা বাজার থেকে।একদিন কমদামে একটু নরম মাছ কিনে এনেছিল সুজাতা,খুব পচা গন্ধ বেরোচ্ছিল বলে ওকে ধমকেছিল রনো।সুজাতা মাছটা একটানে ময়লার ভ্যাটে ফেলে দিয়ে আসে।
রনো পরে ভেবেছিল এভাবে না বললেই হত।মেয়েটা একটু মাছ খেতে পারত।ওরও তো এমনদিন কত গেছে।কাজ শেখার জন্য না খেয়ে দিনরাত পড়ে থাকত মালিকের সেন্টারে।দিনের শেষে কোনদিন ছাতু,কোনদিন শুকনো রুটি।
পুরানো ছোটো সেটটা রনোই দিয়েছিল সুজাতাকে।খুব পরিচিত ছাড়া এমনিতে সুজাতা কাউকে ফোন করে না।তবে কদিন থেকে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসছিল ওর কাছে বারবার।
শুধু হ্যালো বলে চুপ করে থাকে।কোন কথা বলে না।
এমনি করে কয়েকদিন যেতে একদিন রনোকে সব বলে সুজাতা।রনো নম্বরটা দেখতে চায়।নম্বরটা দেখে চুপ করে থাকে রনো।
রনো লক্ষ্য করেছে সুজাতা যখন কাজ করে তখন খুব মন দিয়ে করে।কাস্টমার ওর কাছে কাস্টমারই।কে কি পরে আছে বা কি বলছে সেদিকে ও ফিরেও তাকায় না।মাঝে মাঝে রনো তাকিয়ে দেখেছে, যখন কাজ করে ওর অগোছালো চুল কিছুটা কপালের উপর এসে পড়ে।দ্রুত চুলটা সরিয়ে আবার কাজে মন দেয়।কারোর ফোনে কোনকিছু ডাউনলোড বা ইনস্টল করতে না পারলে আড়চোখে একটু ভয় ভয় করে রনোর দিকে তাকায়,রনোর মাঝে মাঝে খুব হাসি পেয়ে যায়।আবার কাজটা কমপ্লিট করতে পারলে একটা অদ্ভুত সাফল্যের হাসিতে ওর মুখখানা ভরে যায়।
একদিন একটা ছেলে তার ফোনে অনেককিছু ডাউনলোড করে দেওয়ার জন্য সুজাতাকে জোর করছিল,সুজাতার ফোন নম্বরটা চাইছিল।রনো প্রচন্ড রেগে গিয়ে ছেলেটিকে দোকান থেকে বের করে দেয়।
একদিন কাজে এসে খুব অস্থির দেখায় সুজাতাকে।রনো কারন জিজ্ঞেস করে জানতে পারে,,গতকাল রাতে সারারাত ফোন এসেছে ওই নম্বরটা থেকে।ওর মা ভয়ে এখানে আর কাজ করতে দিতে চায় না।কিন্তু এতগুলো টাকা পূজোর বোনাস আর পাবে না এখনি কাজটা ছেড়ে দিলে!! তাই মাকে রাজি করিয়েছে কোনরকমে।
রনো সব শুনে চুপ করে একটু ভাবে,,,,,,
তুমি আমার সামনে ওই নম্বরটায় ফোন করতো,,দেখি কেন হতভাগার কাজ!!
সুজাতা ফোন করে,,বেজে যায় ফোনটা।একবার,,দুবার,,বারবার।কেউ ধরছে না।
কিছুক্ষন পরেই ওই নম্বর থেকে ফোন আসে। রনো বলে,
তোমার যা বলতে মন চায় বলো,,কিছু উল্টোসিধে বললে আমায় দেবে।
কে বলছেন? কথা না বললে ফোন করেন কেন? আপনার এই অবান্তর ফোনের জন্য আমার কাজকর্মের ক্ষতি হচ্ছে।
কোন কথা নেই,,কেউ কিছু বলছে না।
রনো একবার শুধোয় সুজাতাকে,,,সুজাতা কাউকে ভালোবাসে কি না? হয়ত এটা তারই কাজ!! মজা করছে।
সুজাতা খব জেরে মাথা নাড়ে,,,
আমি কাউকে ভালেবাসি না আর আমাকেও কেউ ভালেবাসেনা।সংসারের দুটো ভাতকাপড়ের যোগাড় করতেই আমি ব্যস্ত,তাছাড়া আমি সুন্দরী নই,লেখাপড়াও খুব বিশেষ জানি না,স্মার্ট নই।আমায় কে ভালোবাসবে!!! আর কেউ কাউকে ভালোবাসলে এভাবে মজা করে নাকি?? এটা যে করছে নিছকই মজা করছে আমার সাথে।
ফোনটা কেটে দেয় সুজাতা।ওর দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে আসে।কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কাস্টমার আসায় ও সম্পূর্ন অন্য মানুষ।কাজে ডুবে যায়।

রাতে বাড়ি ফেরার আগে সব গুছিয়ে রাখছিল সুজাতা।রনো বাজারে কিছু কেনার জন্যর গেছে।ওকে সব গুছিয়ে রাখতে বলে গেছে।রনোর একটা ফোন বাজছে,রিসিভ করার আগেই মিসডকল হয়ে যায়।সুজাতা নম্বরটা দেখার জন্য ফোনটা হাতে নেয়।চেক করে,,,,
মাথাটা ঘুরে যায় সুজাতার।রনোর এই ফোনে ওর নম্বর সেভ করা আছে!! কিন্তু রনো বলে যে নম্বরটি ওর ফোনে সেভ করা আছে সেটা তো এটা নয়।এই ফোন থেকে ওর ফোনে একটার পর একটা ডায়ালড কল,,,আজকের মিসডকল গুলোও!! তার মানে!!!!

তোমাকে কথাটা কিভাবে বলব বুঝতে পারছিলাম না সুজাতা।কিন্তু তোমার কাজের প্রতি একাগ্রতা,নিষ্ঠা সবকিছু আমার ভালো লাগতে শুরু করেছিল।তোমার কপালের ওপর পড়ে থাকা চুল কতবার সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করেছে।কতবার মনে হয়েছে ওই চোখ দুটির গভীরে প্রবেশ করতে,,,ইদানীং কোন ছেলে কাস্টমার তোমার সাথে হেসে কথা বললে বা অন্যরকম ব্যবহার করলে আমি সহ্য করতে পারতাম না।সেদিনের আমার ব্যবহারটা এরই কারন।তুমি নিজেও জানো না তুমি আমার কাছে কতটা স্পেশাল,,,,,,,,,
পা যেন আজ আর চলতেই চায় না সুজাতার।সমস্ত ব্যাপারটা যেন ওর কাছে ধোঁয়াশার মতো।রনো সত্যি ভালেবাসে সুজাতাকে???? কি দেখে ভালোবাসল রনো সুজাতাকে?
রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল চিন্তা করে সুজাতা।ফোনটা বাজছে আবার।আজ যেন ভয় আর বিরক্তির পরিবর্তে মনটা অজানা এক আনন্দে থরথর করে কেঁপে উঠল ওর।ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতে গিয়ে একটা জিনিস হাতে ঠেকে।বের করে দেখে আর একটা ফোন!!
সুজাতার ছবি স্ক্রিন জুড়ে।কোন একটা কাজের মূহুর্তের ছবি,,কপালে অবিন্যস্ত ভাবে পড়ে থাকা একগোছা চুল আর একাগ্রভাবে তাকিয়ে থাকা চোখ।কোন একটা সময় কাজে ব্যস্ত থাকার ছবি রনো ক্যামেরা বন্দী করেছে।
আচমকা ফোনটা বেজে ওঠে,,,,,খুব চেনা এই নম্বররটা,রনোর পুরানো সেভ করা নম্বর এটা।ফোনেরর রিংটোনটা বাজছে,,
“আমি তোমার সাথে একলা হতে চাই,,,,”
সুজাতা ফোনটা নিয়ে বারান্দায় আসে,,,আজ অনেককিছু বলার আছে তার, ফোনের ওপারের রাতজাগা মানুষটিকে,,,,,,,অনেককিছু,,,

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*