অভিনেত্রী বানাবার পটভূমিকা

রাজিত বন্দোপাধ্যায়:

হঠাৎ ওর কালো পুঁতির সুতো পড়া হাতটা তার গেঞ্জির গলা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে ভাবেনি সরিতা । বৈতালিক আবাসনের ১৩/সি ফ্ল্যাটে তখন নৈশব্দতা । এখান কার ফ্ল্যাট গুলোতে হই হুল্লোড় নেই বললেই চলে । বনেদী অঞ্চল বালিগঞ্জ প্লেসের গাছ গাছালি ঘেরা আবাসনের বাউন্ডারি গুলো ভীষণ নির্জন মনে হয় ।
ভয়ে মুখ শুকিয়ে এল সরিতার । সিনেমার অভিনয়ে সুযোগ ! এবিধ বিঞ্জাপনে সাড়া দিয়ে যোগাযোগ করেছিল সে । তার বাড়ি নয় , অঞ্চলের লোক বলে সে সত্যি সুন্দরী । আর তাই সে ঝুকে ছিল নাচ গানের দিকে । কবিতা আবৃত্তিও করেছে ইউ টিউবে । আবার স্কুল লাইফ থেকে সে নিয়মিত অভিনয় করছে । বাবার চাকরি টা হঠাৎ চলে যাওয়া আর দাদার চাকরি না হওয়াটা তাকে তাড়িয়ে বেরায় ।
তার উপর সিনেমার গ্ল্যামারাস জীবন , প্রথম সুযোগেই সিঙ্গাপুরের হাতছানি তাকে মোহিত করে ছিল । তাই অভিনেতা সুজয় সিনহার কাজের বিষয়ে আলোচনা কে গুরুত্ব দিয়ে দেখা করতে চলে এসেছিল তার ফ্ল্যাটে । একটু একটু করে গ্লাসের হুইস্কি টা তার আপদমস্তক দেখতে দেখতে শেষ করেছিল সুজয় । মাদকের চাইতেও আরো কিছু নেশার ছায়া নজরে পড়তেই চমকে উঠেছিল সরিতা ।
সুজয়ের ফ্ল্যাটে আর কেউ নেই আজকে । এই তো সুযোগ ! হাত বাড়িয়ে ফিরিয়ে নেবার মানুষ সে নয় । বাধা আসতে শুরু করেছে সরিতার দিক থেকে । বাধা টা তার নেশা কে আরো উসকে দিচ্ছে । চিৎকার করতে পারে মেয়ে টা , তবে তাতে বিশেষ সুবিধা হবে না । উইক এন্ডে এই আবাসন প্রায় খালি থাকে । তবে চুরি টুরি করা অসম্ভব । পাহাড়ার বন্দোবস্ত ভীষণ কড়া । এক যদি সিক্যুরিটিরা আসে । তেমন একটা প্রবলেম খাড়া হবে না । অনেক টাকা টিপস পায় তারা । একটু বাড়িয়ে দিলেই হবে ।
ময়ালের মত জড়িয়ে ধরেছে তার দেহটাকে সুজয় , আর বাধা দিতে দিতে সে ক্লান্ত । হঠাৎ একটা চরম যন্ত্রনায় বীভৎস চিৎকার টা তার গলা চিরে বেরিয়ে এল । তার নগ্ন দেহটা একবার — দুবার নড়ে নিথর হল ।

সুমন্ত দে ইনভেস্টিগেশন অফিসার । আমাকে দেখে একগাল হেসে বললেন , ” চিনতে পেরেছেন তো ব্যানার্জ্জী স্যার ? ” আমি ভালো কোরে দেখে চিনলাম , একুশ রজনী সেন স্ট্রীটের কেসে খুবই সহায়তা পেয়েছিলাম এই অফিসারটির কাছ থেকে । হেসে হাত মেলাতে তিনি আমায় এগিয়ে দিলেন একটা চেয়ার ।
কাল অধিক রাতে ঘুম ভাঙিয়ে ফোন করেছিলেন ডি সি ডি ডি সাউথ কোলকাতা । অরূপ ধর আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন । আজ স্টীল এক্সপ্রেসে হাওড়া স্টেশনে নেমে সোজা পুলিশের গাড়িতে চলে এসেছিলাম লালবাজারে । কোলকাতা পুলিশ কেসটার মোটামুটি সলভ করেছে , কিন্তু ধরা যায়নি খুনের মোটিভ । কাজেই খুনী হাতের বাইরে । আমি সেই জন্যই এসেছি ।

পুলিশ এখন পর্যন্ত জানতে পেরেছে , সরিতা থাকে বর্ধমানের সেহারা বাজার এলাকায় । সুজয়ের অগনিত ভক্তের সেও একজন । ফেসবুকেও তার সাথে যোগাযোগ আছে সুজয়ের । সেখানেই সুজয়কে তার অভিনয় বাসনার কথা জানায় ঐ তরুণী । অভিনয় ও সিঙ্গাপুর ঘুরবার চারেই কুপোকাত সরিতা ।
অ্যারেষ্ট হবার পর সুজয় পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছে যে সে সত্যিই সম্ভোগ করেছে । তবে সে খুনী নয় । সরিতার অসহ্য যন্ত্রনা দেখে তার মানবিকতা জেগে ওঠায় সে তার ভুল বুঝতে পারে । আবাসনের কাছে থাকা রাস্তার কিনারে যে মেডিক্যাল স্টোর আছে , তাতে সে গিয়েছিল অষুধ আনতে । মেডিক্যাল দোকান থেকে বেরোতেই হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তার প্রয়োজকের সঙ্গে , তার সঙ্গে বিশেষ কাজে টালিগঞ্জ স্টুডিওতে যায় । এবং পরিচালকের নির্দেশে সে সারা রাত কাজ করেছে । উপায় ছিলনা , এমনিতেই তার বাজার মন্দা যাচ্ছে । টানআ দুদিন কাজ করার পর তআর ফ্ল্যাট থেকে পুলিশের ফোন আসায় ঘাবরে গিয়ে সে কোলকাতার বাইরে চলে যায় ।
পুলিশ তাকে মন্দারমণির এক রিসর্ট থেকে ধরে আনে । সুজয়ের ফ্ল্যাটে তিনদিন পরে সরিতার গলে যাওয়া পচা দেহ পুলিশ উদ্ধার করে । অদ্ভুত ব্যাপার খুনী রুমের এ সি টা চালু করে রেখে গিয়েছিল যাতে বেশ কিছু সময় লাগে বডিতে পচন ধরতে !
পুলিশ এ অবধি সরিতার এক বন্ধু ও আবাসনের ঐ অংশে থাকা রক্ষীটিকেও অ্যারেষ্ট করেছে । পুলিশ বিল্ডিং-এর সিসি টিভির ফুটেজ ভাল করে দেখেছে , কোন অস্বাভাবিক লোকজন ঢুকতে দেখা যায়নি । তবে ?
সুজয় ও সিক্যুরিটি কে জিঞ্জাসাবাদের ভেরিফাই করা হয়েছে । কোন অসংগতি নেই । মেডিক্যাল স্টোর থেকে জানা গিয়েছে যে সুজয় পেইন কিলার কিনে ছিলেন । এবং দোকান থেকে বেরুতেই একটি বিরাট গাড়ি এসে ফুটপাত ঘেষে দাঁড়ায় ও তা থেকে ড্রাইভার নেমে সুজয় কে বলে প্রয়োজক মশাই ডাকছেন । সে গাড়ির কাছে যায় । গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে দাড়ি গোঁফবালা এক ব্যাক্তি তার সঙ্গে নিম্ন স্বরে কিছু কথা বলে । তারপর সুজয় স্টোরে কেনা অষুধ ও নিজের আবাসন কে দেখে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে উঠে পড়ে ।
খুনের রিপোর্ট পড়ে জানা যায় , সরিতা কে খুন করা হয়েছে যা দিয়ে তাকে বলা হয় নাকেল ডাস্টার । হাতের চার আঙুলের মাপের ফলা তোলা একটি অস্ত্র যাতে আঙ্গুল গলিয়ে ঘুসি মেরে ব্যবহার করতে হয় । সরিতার মাথার পিছনে সজোরে আঘাত হেনে মারা হয়েছে । এ অস্ত্র প্রয়োগে রিস্টের জোর থাকা একান্ত আবশ্যক । এখানে পুলিশ নিরুপায় হয়ে পড়েছে । কেননা রক্ত মাখা অস্ত্র টি থেকে সরিতার রক্ত পাওয়া গেলেও হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি । পুলিশী কুকুর খুনীর রাস্তার কিনার পর্যন্ত যাওয়া ধরতে পেরেছে আবার ফ্ল্যাটে ঘুরে এসেছে । পুলিশের অনুমান রাস্তায় সেইখান থেকেই গাড়িতে করে চম্পত দিয়েছ খুনী ।
আমার দিকে মুখ তুলে ডি ডি ডিসি অরূপ ধর বললেন , ” আপনার কি মনে হয় ব্যানার্জ্জী স্যার ? ”
আমি বললাম , ” অকুস্থল না দেখে অনুমান করি কী করে ? সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি বেরোলো বৈতালিক আবাসনের দিকে ।
ঘরের অবস্থা দেখে বোঝা যায় এখানে কিঞ্চিত ধ্বস্তাধস্তি হয়েছিল । দুটো পায়ের ছাপ স্পষ্ট । কিন্তু বাথরুমে ঢুকে আমার ধারণা এক প্রচন্ড ধাক্কা খেল । কলের পাশে বা হাতের কোণে একটা ছোট্ট তাকে ছিল সাবান কেস টা । শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে । আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে সাবান টা চোখের সামনে তুলে ধরলাম । পুলিশের অছুত জায়গা গুলোর একটা এই বাথরুম টা । সাবানের গায়ে শুকনো আঙুলের ছাপ টা স্পষ্ট । এটা আমার মন বলছে সুজয় বা সরিতার মেয়েলী হাতের নয় । কোন বলিষ্ঠ পুরুষের বুড়ো আঙুলের ছাপ । দ্বিতীয় টা পেলাম বাথরুমের দরজার ভিতরের দিকে । মনে হয় , খুব তাড়া হুড়োয় ধরে ফেলেছে অঞ্জাতসারে । হালকা শুকনো রক্তের ছাপ , তিনটে আঙুল স্পষ্ট । কিন্তু এটা সাবানের দাগটার মত নয় ।
ফটোগ্রাফার আসবার ফাঁকে আমি একাগ্র মনে ছবি টা সাজাবার চেষ্টা করছিলাম । সরিতাকে প্রায় বেহোশ অবস্থায় সম্ববত উল্টো হয়ে পড়ে কাতরাতে দেখে নাকেল ডাস্টার দিয়ে আঘাত হানবার পর খুনীর হাতের মুঠোয় রক্ত লাগে । তারা হুড়োয় সে ছোটে বাথরুমে ধুতে । কিন্তু অপর জনও লক্ষ্য করে তার হাতেও বেড শিট থেকে রক্ত লেগেছে । বেড শিটে মুছতে যেয়ে সাবধান হয়ে গিয়ে সেও ছোটে বাথরুমের দিকে । হাত একবার ধোবার পরও খুনীর সন্তুষ্টি না হওয়ায় দ্বিতীয় বার সে সাবান লাগায় ও সাবানে অজান্তে সে তার আঙ্গুলের ছাপ রেখে দেয় । এদিকে দ্বিতীয় জন নিশ্চই বাথরুমের দরজা অধিক ফাঁক করতে যেয়ে অজান্তেই দরজার পিছনে ছেড়ে যায় হাতের ছাপ !
দুদিন পরে পুলিশের ফরেনসিক ল্যাবোরেটরী কিন্তু আমার ভুল ভেঙ্গে দেয় একটি বিষয়ে । দ্বিতীয় জনের আঙুলের রক্ত টি কিন্তু খুনের রক্ত নয় । সেটি সরিতার যোনি থেকে ক্ষরিত রক্ত । তাতে যে বীর্য মেশা ছিল তা সুজয়ের । কিন্তু হাতের ছাপ দুটি প্রমাণ করে দেয় মৃত্যুর মোটামুটি সময় ও অপর দুজন ব্যক্তির উপস্থিতি ।
আমি সিসি টিভির ফুটেজের আদ্যপান্ত দেখবার পর দু জনকে আরো দুজনের পিছনে বিল্ডিং-এ ঢুকবার ছবি চিহ্নিত করলাম । যাদের আবাসনের বাসিন্দাদের মত চলা ফেরার স্বচ্ছন্দতা নেই বলে মনে হল । সঙ্গে সঙ্গে সেই ফুটেজের ডেভলাপার নিয়ে গেলাম বৈতালিক আবাসনে । সিক্যুরিটি থেকে ফ্ল্যাটের জনে জনে জিঞ্জাসাবাদ করে সেই দুজন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেল । এরা দুজন সন্ধ্যে পৌনে আটটার দিকে ১৮/সি ফ্ল্যাটের শুকদেব ধারার পিছু পিছু আসে বিল্ডিং-এ । শুকদেব ধারা জানান , এদের তিনি পান আবাসনের বাইরের ফুটপাতে । এরা তিন তলার ১৪/সি ফ্ল্যাটের খোঁজ করছিলেন । সিক্যুরিটি জানায় ওটি বিজয় ওবেরয়ের ফ্ল্যাট । তিনি তখনও এসেছেন কি না সন্দেহ প্রকাশ করায় , তারা একবার গিয়ে দেখে আসবেন বলেন ও শুকদেব ধারার পিছনে পিছনে বিল্ডিং-এ যান । শুকদেব ধারা জানান তিনি তাদের তিন তলার ১৪/সি অঙুলি দিয়ে মার্ক করে দিয়ে চার তলায় উঠে যান । সিক্যুরিটিরা অবশ্য তাদের বেরিয়ে যাবার কথা বলতে পারেন নি । টিভি ফুটেজ ও নেই । তবে পিছনের দরজা দিয়ে বেরুলে ফটো থাকবার কথা নয় । বিজয় ওবেরয় পরে জানান এরা তার সম্পূর্ণ অপিচিত ।
দিন দুয়েকের মধ্যে সিক্যুরিটি টিকে ছেড়ে দেওয়া হলেও কিন্তু সুজয় সিনহার বিরুদ্ধে সরিতা কে ধর্ষণ করার চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে । এদিকে আমি সরিতার আরো ডিটেলস যোগাড়ে বর্ধমান গিয়েছিলাম । খুঁজতে খুঁজতে যে রিপোর্ট পেলাম তাতে নিজেই হতবাক হয়ে গিয়েছি ! পুলিশ এখনো জানেনা সরিতা বিবাহিত ছিল ও একজন ডিভোর্সী । তার প্রাক্তন স্বামীর নাম সুরঞ্জন দাম । সুরঞ্জন দাম মন্ত্রী অজয় দামের খুড়তুত ভাই ! এই পরিচয় ভাঙ্গিয়ে সে ধীরে ধীরে টলিউডে বড় প্রয়োজক বনে গিয়েছে । আর টলিউডে খবর নিয়ে জানা গেল , সেই হচ্ছে সুজয় সিনহার বর্তমান শ্যুটিং চলতে থাকা ‘ অমানিশার তারা ‘ ছবির প্রয়োজক । এবার আমায় বসতে হল সিনহার সঙ্গে ।
সুরঞ্জন দাম কে পুলিশ আবিস্কার করে রাজার হাটের এক আলিশান ফ্ল্যাট থেকে । আর গাট্টা-গোট্টা সাবির আলিকে মোমিন পুর থেকে । এবার পুলিশের কাছে কেস স্বচ্ছ হয়ে এসেছে । আমার রিপোর্ট আমি জমা দিয়েছি ডিডি ডিসি সাউথ কে । উনি পড়ে ডজন খানেক থ্যাঙ্কু বলে আমায় এক কফি মগ কফি অফার করে বসলেন ।
আমার যুক্তি ছিল , সুজয় কে বুঝতে না দিয়ে কাজের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল সুরঞ্জন দাম । সুজয় যে ইদানিং সরিতার সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়াচ্ছে সেই খবর পেয়ে সুরঞ্জন সুজয় কে বলে সরিতা কে ফাঁসাতে । নিজের অনেক বছরের পুষে রাখা রাগ অকস্মাৎ তার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল । মেয়েটাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে তৎপর হয়েছিল সে । বিবাহ বিচ্ছেদের সেই বদনাম চ্যাপ্টারটাকে সে ভুলতে পারেনি । এর জন্যই তার হাত থেকে কমললতা বেরিয়ে গিয়েছে । সরিতাকে সে কোনমতেই ছাড়তে পারেনা । নিজের গাড়ির ড্রাইভার সাবির অপরাধী জগতের মানুষ , এই কাজে তাকে হেল্প করতে চায় টাকার জন্যে ও নিজের ড্রাইভারী চাকরি বজায় রাখবার জন্যে । তবে আর কী চাই  , এই তো মোক্ষম সুযোগ । অতএব স্থির হয়ে গিয়েছিল অভিনেত্রী বানাবার পটভূমিকা । আর তার আড়ালেই চেয়েছিল নামিয়ে আনতে শেষের সেই দিন ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*