অব্যক্ত ভালোবাসা

চন্দ্রাবলী:

জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায় শুধুই ঘাসবন–। নাম না কোন জায়গা হবে । বেলাটা পড়ন্ত । হাল্কা কুসুম রঙের আলো চারিদিক ছড়িয়ে আছে ।………… ছোট্ট একটা জলের ডোবা দেখলাম, জলটা শুকিয়ে এলেও তলানী কিছু জল এখনো অবশিষ্ট আছে । তারি মাঝে পানকৌড়ির ডুব-ডুব খেলা , কিন্তু তার সঙ্গী কই ? নাহ… দেখতে পেলাম না । জলটা কেমন যেন ঘলাটে সবুজ । চারিপাশে নরম পলি পড়েছে ।……. আবার দৃষ্টি দূরে গেল………… অনেক দূরে । একটা দেহাতি কোন গ্রাম্য বধু মাঠের আল ধরে হেঁটে আসছে , মুখটা খুব পরিস্কার চোখে না পড়লেও সেযে অল্প বয়স্কা না সেটা অনুমান করা যায় ।……………ট্রেনের গতি আরও শ্লথ হয়ে এল, হয়ত কোন স্টেশনে থামবে । ঝুপ করে আকাশ, সমস্ত প্রকৃতি কালো চাদরে কখন যে ঢেকে দিল খেয়ালই করিনি । সম্বিত ফিরে এল যখন দেখলাম স্টেশনে আলোর মেলা ।

পুরো একদিন হয়ে গেল ট্রেনে আছি, সঙ্গী হিসাবে আছে একটি বাঙালী পরিবার । যাদের গন্তব্যস্থান একই, আর আছেন একজন ভোজপুরী বৃদ্ধা যিনি বেনারস যাবেন । বৃদ্ধা জানালার পাশে বসে অনেক খেলনা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন , প্রথমে ভেবেছিলাম তার নাতি অথবা নাতনী সঙ্গে আছে । কিন্তু পুরো একদিন হয়ে গেল তাকে একাই দেখলাম । কৌতুহল চাপতে না পেরে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম সঙ্গে তার কে আছে । সে বললো তার সবাই আছে । ছেলে- বউ- নাতি, কিন্তু সাথে কেউ আসেনি । সে নাতির কথা বলতে শুরু করল, কেমন করে তার নাতি আদো গলায় দাদি বলে ডাকে কেমন করে বায়না করে, কেমন করে দুষ্টুমি করে তাকে বিরক্ত করে, কেমন করে গল্প করে খাওয়ায় । সে শুধুই তার নাতির কথা বলে যাচ্ছিল আর আমি দেখছিলাম তার দু- চোখ জুড়ে অপত্য স্নেহ , এ সবখেলনা তার নাতির জন্য কিনে রেখেছে । কিন্তু তারপর সে যা বললো শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম । পাঁচ বছর ধরে সে খেলনা গুলো জমিয়ে রেখেছে তার নাতির জন্য । সে জানে না তার নাতি এখন কোথায় । চাকরি সুত্রে তার ছেলের বদলির সময়, পথে সে তার ছেলের সঙ্গছাড়া হয়ে যায়, আর খুঁজে পায়নি ছেলেকে । সে অজ্ঞা-অশিক্ষিতা তাই ছেলে কি চাকরি করে সেটাও বলতে পারছে না সঠিক করে, বা ছেলেও কোন চেষ্টা করেনি মা- কে খোঁজার, হয়তো চায়নি মা কে তাদের নতুন জীবনে। তবুও বৃদ্ধার অগাধ আশা সে তাদের কে একদিন ঠিক খুঁজে পাবেই, সেই আশাতেই এক এক করে খেলনা জমিয়েছে..।এ এক অব্যক্ত ভালোবাসা, হায়রে ভালোবাসা — যার কোন মুল্য হল না ।

অনেক রাত হল, বৃদ্ধা আর আমি ট্রেনে মুখ-মুখি বসে । বৃদ্ধার দু-চোখে জলের ধারা, হাতে অতি স্নেহের সাথে ধরা খুব সাধারন, ফুটপাথের একটা খেলনা । আমার বুকের ভিতরটা শুন্য হয়ে গেল, জানিনা বৃদ্ধার গন্তব্য কোথায় শেষ ।।।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*