ম্যাও আর মিনি

মৃগাঙ্ক চক্রবর্তীঃ

সকালে বাজার থেকে ফিরে কাগজ নিয়ে বসলাম। চিঠি লিখতে হবে একটা। আজকাল মেইল আর হোয়াটস অ্যাপের যুগে চিঠি জিনিসটা প্রায় ব্রাত্যই হয়ে গেছে। লেখালিখির অভ্যাসটাও  অনেকদিন থেকে নেই। ছোটো বেলায় কিছু লেখার একটা গতি হয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু তারপর পড়ার চাপ আর চাকরী খুঁজতে গিয়ে সুখতলি খুইয়ে লেখার অভ্যাসটা কোথায় জানি মরে গেলো। কিন্তু আজ হঠাৎ লিখতে ইচ্ছে করছে খুব- এতদিনের সব কথা মন খুলে লিখতে হবে।

প্রিয়,

মিনি,

অনেকদিন পর তোকে এই নামে ডাকলাম। না হলে তো নামটা হারিয়েই যেতে বসেছিল। হয়তো হারিয়েও যাবে কিছুদিন পর। মনে আছে , অভিজিৎ স্যার এর টিউশনে তোকে আর আমাকে সবাই এই ম্যাও আর মিনি নামে ডেকে ডেকে ক্ষ্যাপাতো ? প্রথম প্রথম তো কি রাগটাই না করতি তুই। সেসব এখনও চোখের সামনে ভাসে। মনে হয় এইতো সেদিনের কথা।

অবশ্য পরের দিকে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও , ভেতর ভেতর যে ভালোই রাগে ফুঁসতিস তা আর বুঝতে আমার বাকি ছিল না।

প্রথম যেদিন আমাদের ফিজিক্স টিউশনে তুই এলি , তোর লেয়ার কাট খোলা চুল আর নিখুঁত লাগানো আই-লাইনার টা দেখেই তোর ওপর ক্রাশ হয়ে গিয়েছিলো। কম বয়সে তখন ছিলাম বলিউড ফিল্মের পোকা। তাই ওই “ লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট “ ব্যাপারটায় বিশ্বাস আর ভক্তি দুটোই ভালোরকম পরিমাণে ছিল। ওদিন ভেবেছিলাম , তুই আমার সামনাসামনি বেঞ্চটায় বসলে, পড়া বোঝার ছুতোয় এদিকে ওদিকে তাকানোর ফাঁকে তোর দিকে ক’বার ঝাড়ি মারা যাবে। কিন্তু বসলি গিয়ে কোনার বেঞ্চিটায়। সমস্ত আশাই পুরো জলে ডুবে গেলো। সেদিন আবার ছিল আমাদের ফার্স্ট টিউশন টেস্ট। নিউটন-এর গতিসূত্র লিখতে গিয়ে যখন দ্বিতীয় গতিসূত্রটা ভুল লিখলাম আর স্যার-ও খাতা দেখার সময় আমাকে সুযোগ বুঝে সবার সামনে বেশ ভালোরকমই বকাবকি করলো , তখন তোর সামনে বকা খেতে ভারি লজ্জা করছিলো। ভাবলাম প্রথম দিনেই বুঝি ইম্প্রেশন খারাপ করে দিলাম তোর কাছে। যদিও পরে জেনেছিলাম তুই অতোতা খেয়াল করিসনি ওটা। তুই তখন নাকি সংকেত-এর খাতা থেকে আগের নোট্‌সগুলো লিখতে ব্যাস্ত ছিলি।

এভাবে টিউশন এগিয়ে গেলো। তোর সঙ্গে প্রত্যেক সপ্তাহে দু’দিন করে দেখা হতে লাগলো। কিন্তু কথা আর বলা হয়ে উঠছিলনা। সুযোগ খুঁজতাম বইকি। কিন্তু উপায় পাচ্ছিলাম না খুঁজে।

একদিন তো নোট্‌স চাওয়ার বাহানায় তোর সঙ্গে কথা বললাম খানিকটা যেচে যেচেই। সেদিন তোর খাতাটা বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। জানি , জেরক্স করে সঙ্গে সঙ্গে ফেরত দিতে পাড়তাম; কিন্তু তাহলে তো তোর সাথে ভালোভাবে কথা বলাটা হতো না।

পরদিন টিউশন এর শেষে খাতা দেওয়ার ছুতোয় তোর সঙ্গে প্রথম ভালো করে কথা হল। তোর নাম্বারটা নিলাম কি একটা দরকারের অজুহাত দেখিয়ে জানি…… ভুলে গেছি , অনেকদিন তো হল-মনে নেই অতো।

তারপর থেকে তো পড়ার ব্যাপারে কথা বলার বাহানায় তোকে প্রায়ই ম্যাসেজ করতাম। তখন তো হোয়াটস অ্যাপ বা হাইক ছিল না। ওই ২০ টাকার ম্যাসেজ প্যাক-ই ভরসা ছিল। আগে সপ্তাহে দু-তিনবার ম্যাসেজ করতাম। পরে যদিও সেটা সপ্তাহ পেড়িয়ে দিনে গিয়ে ঠেকল। এরপর প্রতিদিন রাতেই তোর সাথে ম্যাসেজে কথা হতো।

“সিলেক্ট এ নাম্বার “ জাতীয় ম্যাসেজ বা খুচরো জোকসগুলো তোকে পাঠাতাম আর তুই একটু বাজে যে জোকসগুলো ছিল, ওগুলো শুনে রিপ্লাই করতি- “ছিঃ! থাম এবার।“ তারপর চলতো ক্যাজুয়াল কথাবার্তা- কে তোকে প্রোপোজ করেছে স্কুল ফিরতি কিংবা তোর বাবা তোকে পড়তে পড়তে মোবাইলে ম্যাসেজ করতে দেখে নিয়েছে আর বলেছে এরপর মোবাইল নিয়ে নেবে। বিশ্বাস কর , ওই কথাগুলো শুনলে খুব ভয় পেতাম তোকে হারানোর। তাইতো টপিক চেঞ্জ করে দিতাম।

এরপর থেকে আমরা টিউশনে পাশাপাশি বসতাম। তখন তোর আর আমার বন্ডিংটা বেশ শক্তপোক্ত ছিল। সেই “ টিচার্স ডে ”-র দিন স্যার আমাকে আর অনির্বাণকে টাকা দিয়ে বললেন সবার জন্য সিঙ্গারা নিয়ে আসতে।  নিয়েও আসলাম ওনার কথামতো। সবাইকে সিঙ্গারা বিতরণ করার ফাঁকে তোকে সবচেয়ে বড়ো সিঙ্গারাটা দিয়েছিলাম। মনে আছে , পরে তুই জিজ্ঞেস করেছিলি তোকে বড়োটা কেন দিলাম ? আমি ওদিন তোকে দিতে পারিনি কোনো খাপ খাওয়ানো উত্তর । কিভাবে দেবো বল দেখি ? যদি বলতাম যে, তোকে ভালবাসি…… তবে কি এই ফ্রেন্ডশিপটা আর থাকতো বল?

হ্যাঁ। তোকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। যদিও যতদূর জানি যে তুই এর কিছুই জানতিস না।

একদিন তুই বললি যে, তোকে তোর বাবা টিউশনে দিয়ে যাবে সেদিন , তাই বাইরে দেখা হলেও যেন ওরকম যেচে কথা না বলি তোর সাথে। তোর  বাবা খুব পজেসিভ। দেখলে বকা দেবে তোকে। আমিও বাধ্য ছেলের মতো সেটাই করলাম। তুইও আমার সামনে দিয়েই টিউশনে ঢুকলি আমাকে না চেনার ভান করে…যদিও আড় চোখে তাকিয়ে একবার মুচকি হেসেছিলি। ততদিনে সবাই আমাদের কাপল ভাবা শুরু করে দিয়েছিলো। তুই যেদিন স্যারের বাড়ির সামনে থেকে বেড়ালের বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে নিজের বাড়ি নিয়ে গেলি , তারপর থেকে তোকে সবাই “মিনি” নামে ক্ষ্যাপায়। আর আমাকে ডাকতো “ তোর ম্যাও ” নামে। বিরক্ত হওয়ার ভান করলেও মনে মনে বেশ খুশিই হতাম।  আমরা প্রেম করছি সবাই ভাবলেও, আমরা তখনও সেই ফ্রেন্ডশিপের গণ্ডীতেই আটকে ছিলাম। গণ্ডী অতিক্রম করার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। ভাবতাম প্রপোজ করে ফ্রেন্ডশিপ নষ্ট করার চেয়ে ক্রাশ টা বুকে চেপে বন্ধুত্বটাই ভালো। এরপর  টিউশনে তুই আস্তে আস্তে আমার পাশে বসাটা বন্ধ করলি। পরের দিকে তো সহেলীর পাশেই বসতিস। বুঝলাম তুই অস্বস্তি বোধ করছিস এই ইয়ার্কিগুলোয়। তোকে কারণটা জিজ্ঞেসও করেছিলাম। তুই বলেছিলি যে, তোর বাবার কানে এরকম একটা ভুয়ো খবর গেলে তোর বিপদ হবে। তোর বাবা নাকি খুব রাগী। উনি নাকি তোর সব টিউশন বাদ দিয়ে বাড়িতে মাস্টার রেখে  তোকে পড়াবে। আমিও তারপর থেকে তাই ম্যাসেজ করাটা কমিয়ে দিলাম তোকে। টিউশনেও একটু দূরত্ব বাড়িয়েই রাখলাম। যেকয়টা ম্যাসেজ করতাম, সেগুলোরও খুব একটা রিপ্লাই করতিসনা তুই আর রিপ্লাই করলেও খুব সংক্ষেপে এক-দু কথায় কথা শেষ করতিস। কারণ হিসেবে বলেছিলি যে , তোর বাবা নাকি কিছু একটা তোর ব্যাপারে আঁচ করে তোকে সন্দেহ করছে। আমিও আর তোকে জ্বালাইনি।

তোর মনে আছে আমাদের টিউশনের শেষ দিনটার কথা ?

সেদিন আবার তুমুল বৃষ্টি ছিল। এদিকে টিউশন বাদ দেব শুনলে বাবা রাগ করে পিঠে দেবে দু’ঘা। বাধ্য হয়ে এলাম টিউশনে। তুই একটু দেরী করে এলি। মাঝরাস্তায় ছাতা ছিড়ে যাওয়ায় ভিজে একসার হয়েছিলি।

স্যার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন আমাদের পুরো বই-এর ওপর ; আমাদের লেখা আগেই শেষ হয়ে গেছিলো ; তাই সবাই চলে যাচ্ছিলো। স্যারের কড়া নির্দেশ ছিল যে , পরীক্ষার পর সোজা বাড়ি- কোনো দাঁড়ানো চলবে না।

আকাশটা খারাপ ছিল দেখে কেউ আর দাঁড়ায়নি। এমনিতেই তুই দেরী করে লেখা শুরু করেছিলি বলে তোর লেখা তখনও বাকি ছিল ; ভেতরে লিখছিলি তুই। আমি তোর জন্য বাইরে অপেক্ষা করে ছিলাম এই ভেবে যে তোর হলে একসাথে যাব ; তার ওপর আমার কাছে ছাতাও ছিল।

তুই লেখা শেষ করে বাইরে এসে আমাকে অপেক্ষা করতে দেখে হঠাৎ খুব রেগে গেলি। ভালোমতোই বুঝিয়ে দিলি যে , আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছুই নেই। একেই আমার বাড়াবাড়ির জন্য নাকি তোকে অনেক ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে। আমি যেন এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করি। তাহলে আমাদের মধ্যে সেই বন্ধুত্বটাও আর থাকবেনা।

সেদিন খুব রাগ হয়েছিলো তোর ওপর। তারপর তোর সাথে আর যোগাযোগও রাখিনি আর তুইও যোগাযোগটা রাখতে চাসনি। ফোন নাম্বারটাও ডিলিট করে দিয়েছিলাম। পরে একদিন তোর বান্ধবী পল্লবীর মুখে শুনেছিলাম তোর আর আমাদের টিউশনের অনির্বাণের মধ্যে কীসব জানি চলছিলো। অবাক হলাম ; এতটুকুও আঁচ পেতে দিসনি তুই আমাকে। ভেবেছিলাম সত্যি টা বললে কি ক্ষতিটাই হতো ?

সব কিছুই পরিষ্কার হোলো। এরপর কলেজে উঠলাম…… তোর সাথে আর কোনোদিন সেভাবে দেখাও হয়নি। আর রাস্তায় যে দু’একদিন দেখা হয়েছিলো আমাদের, না তুই আমাকে চিনেছিস আর না আমি তোকে চেনার ভান করেছি।

পরে শুনেছিলাম কার মুখ থেকে জানি যে, অনির্বাণ তোকে ছেড়ে ওদের কলেজের কোনো একজনের সাথে এনগেজ হয়েছিলো।

কলেজ পাশ করার পর একদিন শুনলাম তোরও নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে। কার সাথে……কী বৃত্তান্ত…… কিছুই জানিনা- জানার চেষ্টাও করিনি। আমিও আমার সংসার গুছিয়ে নিয়েছি। পাশ করার পর সরকারি চাকরী হয়নি আর। বেসরকারি কোম্পানিতে এখন আমি প্রোজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার। বিয়েও করেছি। বউ বাচ্চা নিয়ে দিব্যি ব্যস্ত আছি। তোকে তো বলাই হয়নি। জানিস আমার মেয়ের নাম আমি “মিনি” রেখেছি। ব্যাখ্যা চাসনা যে কেন রেখেছি। ব্যাখ্যা দিতে পারবনা।

কাল হঠাৎ ব্যাঙ্ক থেকে ফেরার সময় তোকে দেখলাম। পাশে একটা বাচ্চা ছিল। সম্ভবত তোর মেয়ে হবে। দেখতে এখনও আগের মতোই আছিস। এতটুকুও মোটু হোসনি। একদম একইরকম আছিস এখনও। খুব ডায়েট করছিস মনে হল।

যাই হোক, কাল তোকে দেখার পর থেকেই ভাবছিলাম তোর সাথে একবার কথা বলবো। দেখার ইচ্ছে যে এখনো রাগটা চেপে রেখেছিস নাকি। সেটার সাহস হোলো না। তাই মনের যা কিছু এই চিঠিতেই উজাড় করলাম।

যেখানেই থাকিস , ভালো থাকিস।

ইতি,

ম্যাও

লেখা শেষ করে , চশমাটা খুলে রাখলাম। দু’হাত দিয়ে মুখটা ঘষতে ঘষতে চিঠি লেখা কাগজটা গোলা পাকিয়ে পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম। আকাশটা আজও মেঘলা করেছে। আজও হয়ত বৃষ্টি নামবে। শুধু আজকে বৃষ্টিতে ভেজার কেউ নেই। অপেক্ষা আছে হয়ত। শুধু অপেক্ষা করার ইচ্ছাটা মরে গেছে। ভালবাসাটাও কোথাও একটা আছে ; কিন্তু সেই ভালোবাসাটা অনেক বেশী সাবালক।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*