প্রবন্ধ- মানবতার অবক্ষয়

চন্দ্রাবলী ব্যানার্জীঃ

মানবতার অববাহিকাতে আজ মানবতার নৈরাজ্যের প্রতিস্থাপন চলছে ।সমাজের উচ্চ থেকে নিম্ন অথবা নিম্ন থেকে উচ্চ একই চিত্ররূপ । আমাদের এই প্রগতিশীল তথা আধুনিক সমাজ একটু একটু করে ছেড়ে দিয়েছে মানবতার প্রসারিত হাত । তার বন্ধ মুষ্টিতে এখন অমানবিকতার চাবিকাঠি । সেই চাবিকাঠি দিয়ে সে জয় করবে পৃথিবীর সমস্তরকম সুখ-বিলাস- বৈভব ।

একমাত্র লক্ষ্য এগিয়ে চলা সর্বজয়ের উল্লাসে । তার জন্য আপোষ করবে না কোন কিছুর সাথে ।

সেই জন্যই আমাদের শিশুরা আজ পন্যের বস্তু, চিকিৎসা, শিক্ষা আজ পন্য। এর জন্য দায়ী কে? আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ (অবশ্যই পুথিগতি শিক্ষা) । যার যত বৈভব, যে যত বিত্তশালী তার শিক্ষার প্রসার তত বেশী ।

তার জন্য প্রচুর ত্যাগ করেছে আমাদের এই শিক্ষিত সমাজ । ত্যাগ করেছে বাবা- মা এর সান্নিধ্য , ত্যাগ করেছে সন্তানের সান্নিধ্য । বাবা- মা – সন্তানের সাচ্ছন্দ্যের জন্য রেখেছে বৃদ্ধাশ্রম বা ছাত্রাবাসে । এটা কি কম বড় কথা !! আরো অর্থ, আরো প্রাচুর্য এনে দিয়েছে স্বীয় স্বীয় মৌলিকত্ব ।

একটা সন্তান যখন আসে পৃথিবীর বুকে, তাকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করা হয় এই নব্য সমাজের উপযুক্ত করে। সে শুধু বাবা-মা কে নিয়েই নিজের জগৎ বিস্তার করে । আমরা কি দিলাম আমাদের সন্তানদের? দিলাম ভবিষ্যত পথের সর্বজয়ের ঝান্ডা, আমাদের আগামী প্রজন্মের পথিকৃত করে তুললাম। কোথায় পেল তারা ঠাকুরমারঝুলি, রূপকথার রাজা রাণী, মহাপুরুষের জীবনী আর কোথায় পেল ঠাকুমার আঁচলের নিচে নি:শ্চিন্ত আশ্রয়, কোথায় পেল ভাই অথবা বোনের সাথে খুনসুটি ? তাদের হাতছানি দেয় না চু- কিৎ কিৎ, গোলাছুট, কানামাছি অত্থবা লুকচুরি । ডাক দেয় না সবুজ খোলা প্রান্তর । আর ডাক টাই বা দেবে কি করে । আমরা তার অবকাশ রাখিনি, সেখানে তুলেছি ধনী সমাজের বস্তি বাড়ি । পেল শুধু মৌলিকত্ব, আত্মকেন্দ্রিকতা ।

দরকার কি আমাদের অধিক সন্তানের, একটি সন্তান যথেষ্ট এই নব্য সমাজের বদলি করনের জন্য। সেও নিজেকে প্রস্তুত করে প্রগতিশীলতার ধারক ও বাহক রূপে । আর অনুকরন পিয়াসী মধ্যবিত্ত তারাও পিছিয়ে নেই এই সর্বজয়ের যাত্রায় , এই মিছিলের তারাও সমান অংশীদার।। এই নব্য সমাজের মানুষের মধ্যে ছয় রিপুর প্রসারতা অনেক বেশী । ছোট শিশুটির মধ্যেও থাকে রিপুর তাড়না ।

সে চায় তার রাগ, হিংসা, খুনসুটি প্রকাশের জায়গা । বেছে নেয় বাবা- মা কে । তাই আজ বাবা-মা এর প্রতি যে সন্মান, আনুগত্য তার পথ পরিবর্তন হয়েছে। সবটাই অর্পণ করেছে সর্বজয়ের চরণে । ইদুর দৌড়ের একজন সদস্য হয়ে ওঠে, ধীরে ধীরে সেও নিমজ্জিত হয়ে পরে এই সর্বজয়ের উল্লাসে । ত্যাগ করতে শিখে যায়, বাবা- মার স্নেহ, ভালোবাসাকে । দোষ দিই আমাদের সন্তানকে । কিন্তু তার অপরাধ কোথায়? তাকে আমরাই দিইনি মনবিকাশের বিচরণ ক্ষেত্র । ছোট থেকে যার মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়নি ভালোবাসার মুকুল, প্রথিত হয়নি স্বার্থত্যাগ এর ভ্রূন ,

তার কাছে থেকে কি আশা করা যায় মানবিকতা ? এগুলো শুধুই প্রহসন তার কাছে ।

বিগত সমাজ আমাদের উপহার দিয়েছে বড় বড় গুনী মহাপুরুষদের । তারা মৌলিকত্ব নিয়ে বেড়ে ওঠেনি, গড়ে ওঠেনি তাদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা, পায়নি নব্য সমাজের ইঁদুর দৌড়, তারাও মানুষ ।

আমরা নিজেদের আধুনিক সমাজের বাহক হিসাবে গন্য করি । এই কি আধুনিক তথা প্রগতিশীল সমাজের চিত্রপট ? লাভকি তাহলে এই নব্য সমাজের ? নাকি একেই বলে আধুনিক – আদিম সমাজ?

যেদিন এ চেতনা বোধ আসবে মানব সমাজে, যে দিন মৌলিকত্ব ছেড়ে প্রগতিশীল প্রতিযোগিতার রদ হবে সেদিন নব জাগরণ হবে সমাজের, আবার অঙ্কুরিত মানবতার ভ্রূন । সেদিন আমাদের সমাজ আবার পাবে, বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাসচন্দ্র, বিধানচন্দ্রের মত মহা পুরুষদের । প্রতিক্ষায় রইলাম সেই নবজাগরনের প্রত্যাশায় ।।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*