সেই লোকটা

নিবেদিতা ঘোষ মার্জিতঃ

বন বন করে ঘোরা নাগরদোলা থেকে চোখ নামিয়ে আপাং বুঝতে পারে সে হারিয়ে গ্যাছে। মা পাশে নেই। চারপাশের মানুষের মুখের দিকে তাকাল। চেনা কেউ নেই।মা গ্যাল কথায়?তেঁতুল গাছটায় ওঠে আপাং।গোটা মেলা দ্যাখা যাবে। ভ্যাদাকে দেখতে পেল আপাং। বাবার কাঁধে চেপে মেলায় ঘুরছে সে। ওই তো মা। বুড়ো বাবার মন্দির এর পাশের বট গাছের নীচে বসে আছে। পাশে লোক টা কে?
সূর্যাস্তের আলো ইস্কুল বাড়ির ওপর পরেছে। তেঁতুল গাছ থেকে নেমে দৌড় লাগালো আপাং। একছুটে বটগাছটার কাছে এসে দেখলো। লোকটা চিত হয়ে শুয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখছে। মা হাঁটুতে মুখ ঢেকিয়ে খুব করুন মুখে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে। আপাং এর চোখ ফেটে জল এল। “হারিং গেলে কি করত্যা… ছেল্যা ধরা ধরি লিয়ে গেলে কি করত্যা”। বুকের ভেতরের অভিমান অস্রু হয়ে গাল বেয়ে চিবুকে এসে পড়ে।
মা হাত বাড়িয়ে দিতে ৭ বছরের আপাং মায়ের বুকে ঝাঁপ দেয়। লোক টা উঠে বসলো । এতক্ষণে আপাং দেখল লোকটার পায়ে পিকনিক করতে আসা বাবুদের মতন জুতো। বাসি দাড়ির মধ্যে দিয়ে কালো চামড়া। নাকটা বোঁচা, থ্যাবড়া। আর চোখে জ্যান কি একটা আছে। অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলল “ হারিং গেলে তুমাকে ঠিক ঢুঁরে লিয়ে আন্ত্যাম”…লজেন খাবা”।
সবুজ রঙের লজেন্স হাতের তালুতে ধরে লোকটা খেতে দিল। তালুটা বিরাত।ভয়ে আপাং মায়ের বুকে ঢুকে গেল।“ ধ্যার হ্যালসা ছুঁড়া ভয় পেছিস ক্যানে। ভয় নাই”।মা হেসে হেসে বলছে।
লজেন্স চুষতে চুষতে আপাং দেখল মেলার দোকান গুলোতে আলো জ্বলতে শুরু করেছে ।মাইকে “একটা কিনলে একটা ফ্রী” , বশীকরণ তাবিজ” আর হাজার আওয়াজ। গ্রাম দেশে ৭ বছরের ছেলে মা কে আঁকরে থাকে না।আপাং থাকে।
লোকটার হাতের কব্জি বেশ চওড়া । লোক টা বলে “ লাগর দোলায় ছরভ্যা?”আপাং অবাক হয়। এভাবে তাকে কেউ বলে না। আপাং বোঝে ভ্যাদার বাপ যেমন ভ্যাদা কে কাঁধে চরিয়ে মেলায় নিয়ে এসেছে ওর বাবা এমন পারে না।অর বাবা বিছানায় হাগে মোতে । মা পরিস্কার করে। বাবার আগের পক্ষের বউ কে আপাং বড় মা বলে ডাকে। বড় মা, তার ছেলে মেয়ে দিনে একবার করে বাবার ঘরে আসে। পার্টি অফিসের কথা, জমি, ব্যাবসা, এইসব নিয়ে কথা বলে। আপাং এর মা ওসবের মধ্যে কোন কথা বলে না। বড়মা আপাংকে কোনদিন তাদের দোতলার ঘরে উঠতে দেয় না। তবে মাছ ,দুধ,ডিম বেশ গুছিয়ে খেতে দেয়। আপাং এর খুব খিদে।
নাগর দোলা থেকে নেমে এসে লোক টা আপাং কে বলে “ ঘুগনি খাবা”? আপাং এর লোক টাকে খুব ভাল লাগে।সন্ধ্যে আর একটু ঘন হলে লোক টা হঠাৎ চলে গ্যাল। যাবার আগে কেবল মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। মা তার শুকনো গাল মুছে সরকা পুকুরের ধার ঘেঁসে আপাং এর হাত ধরে হাঁটতে লাগলো।
বাড়ী ফিরে কল থেকে জল তুলে মা চানে গ্যাল। একটু আড়াল দরকার। কাঁদবার।বাবা ঘর থেকে চিৎকার করে “ এ ছুঁড়া তর মা কতি গ্যালো।এক পেট পেছছাব…। তু প্যান টা দে”“ আপাং চৌকির তলা থেকে ইউরিন্যাল দেয়। মা চান সেরে ঘরে ফিরে মৃদু স্বরে বলে, “ অকে দিয়ে প্যান না লিলেই হছিল না। বাড়িতে আর লুকজুন নাই”। প্রত্যুতরে গালাগালি ফেরৎ আসে। আপাং এর খুব রাগ হচ্ছিল।
রাতে মা ছেলের মেঝে তে পাতা বিছনায় মরা জ্যোৎস্না র আলো। মেলার নাগর দোলার আনন্দ টা তে আপাং এর বুক ভরে আছে।বিছানায় শুয়ে আপাং এর মনে হচ্ছিল , ইস ভ্যাদার মতন যদি বাবার কাঁধে উঠে মেলা দ্যাখা যেত।আপাং এর মা রোজ যে হিসেব টা করে আজ সেটা আবার করলো।এখনো ছয় বছর, তিন মাস, দশ দিন।আর আপাং জানে না সেই লোকটারও আজ খুব ইচ্ছা হচ্ছিল আপাং কে কাঁধে চাপিয়ে মেলা দ্যাখায়।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*