বাঙালি-অবাঙালির ভেদাভেদহীন ধনতেরাস আজ সার্বজনীন

dhanteras hd wallpaper in 1080p

তপন মল্লিক চৌধুরী : ধন-সম্পত্তিতে সমৃদ্ধ রাজা হিমের মনে শান্তি নেই। থাকবেই বা কী করে? রাজ-জ্যোতিষীরা যদি একমাত্র পুত্রর কোষ্ঠী বিচার করে এমন একটা আশঙ্কার কথা জানায় তাহলে কি কোনও পিতার মনে শান্তি থাকতে পারে, না কি তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন? মাত্র ষোলো বছর বয়েসেই হিম-পুত্র-র কোষ্ঠী বিচারে দেখা গেল, বিয়ের চতুর্থ রাতে তাঁর সাপের কামড়ে মৃত্যু হবে। নিস্তার পাওয়ার জন্য যা যা খোঁজখবর নেওয়ার তাতে রাজা হিম কোনও খামতি রাখেননি। কিন্তু কোনও উপায়ই মেলেনি। এদিকে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের বিয়ে তো দিতেই হবে। একদিন সেসবও ঠিকঠাক হয়ে গেল। বিয়ের রাতেই নববধূ সে খবরও জেনে ফেলল। মন শক্ত করে সে এই নিশ্চিত মৃত্যু রোধ করবে বলে মনে মনে পণ করল। নিজের ভাবনা মতো সে চেষ্টাও করল। বিয়ের চতুর্থ রাতে নববধূ তার স্বামী রাজা হিম-পুত্রকে ঘুমোতে দিল না। নিজের সমস্ত অলঙ্কার গা থেকে খুলে, সিন্দুক থেকে বের করে সে ঘরের মাঝখানে স্তূপাকৃতি করল। এরপর সারা ঘর জুড়ে সে অসংখ্য প্রদীপ জ্বেলে দিল। সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর এ ধরনের কাণ্ড দেখে তো হিম-পুত্র অবাক। সে নববধূকে একের পর এক প্রশ্ন করে চলে কিন্তু নববধূ এক মনে ঘর সাজিয়ে চলে প্রদীপে। অত প্রদীপের আলো সোনার অলংকারের ওপর পড়ে দ্বিগুণ বিচ্ছুরিত হতে থাকে। ঘরের চারপাশ আলোর ঝলকে ঝলসে উঠতে থাকে। আশ্চর্যের এখানেই শেষ নয়। এমন এক পরিবেশে নববধূ এবার গান ধরে। গানের গলাটিও তার মধুর এবং খুবই সুরে চলে। এবার তার স্বামী সত্যিই মুগ্ধ হয়ে পড়ে। একটা গান শেষ হলে আরেকটি। এরকম চলতে চলতে একসময় যমরাজ এসে উপস্থিত হয় ঘরে। নববধূর গান থামায় না, তার স্বামী মুগ্ধ শ্রোতার মতোই নিশ্চল থাকে। কিন্তু আলোর ঝলকানিতে যমরাজের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। অন্যদিকে নববধূর গান তাকেও আবিষ্ট করে ফেলে। চোখ বন্ধ করে সে গান শুনে বিদায় হয়। একসময় রাতের অন্ধকার ফুরিয়ে গিয়ে ভোর হয় আর কেটে যায় রাজপুত্রের ফাঁড়া। বলা হয় সেই থেকেই নাকি ধনতেরাস আলোর উৎসবে পরিণত হয়েছে। উৎসবের আগে ঘরবাড়ির নতুন রূপ দেওয়া হয়। সব কিছু যেন ঝাঁ-চকচকে হয়ে ওঠে। সম্পদের দেবীকে আবাহনের জন্য বাড়ির প্রবেশপথ খুব যত্ন নিয়ে সাজানো হয়। সঙ্গে আলোর মেলা তো আছেই। বাড়ির দরজা থেকে ভিতর পর্যন্ত দেবীর পদচিহ্ন আঁকা হয় আলপনা দিয়ে। ধনতেরাস নিয়ে এই গল্পটি প্রচলিত আছে। তবে একথা ঠিক যে, বেশ কয়েক বছর আগে পর্যন্ত অ-বাংলা অঞ্চলের ও অ-বাংলা ভাষাভাষীদের মানুষই এই উৎসবে সামিল হতেন। কারণ, এই উৎসব অনুষ্ঠানটি মূলত উত্তর ভারতের। সাম্প্রতিক সময়ে এটি এই বাংলায় ক্রমশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাঙালি-অবাঙালি ভেদাভেদ মুছে ধনতেরাস আজ সার্বজনীন। কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের জেলা শহরগুলিতে ধনতেরাস পালিত হয় ব্যাপক ধুমধামের সঙ্গে।

উত্তর ভারতে পাঁচ দিনের দেওয়ালি উৎসব হয়ে থাকে। প্রথম দিন হল ধনতেরাস ধনত্রয়োদশী বা ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী নামেও পরিচিত। হিন্দু ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশ দিনে পালিত হয় ধনতেরাস। ইংরেজি ক্যালেণ্ডারের হিসেবে অক্টোবর বা নভেম্বর। ধন মানে ধনসম্পত্তি। এই দিনে লক্ষ্মীর বাহন পেঁচাকে পুজো করা হয়। মনে করা হয় পেঁচাকে পুজো করলে সংসারে সুখ হবে, ধনসম্পত্তি বাড়বে। এই দিনে সোনা বা রূপোর গয়না বা অন্তত কিছু নতুন বাসনপত্র কিনে থাকেন অনেকেই। মনে করা হয় শুভ। বছরের অন্য সময়েও সোনার দোকানগুলি বেশ কিছু আকর্ষণীয় ছাড় দেয় তবু ধনতেরাস উপলক্ষে যে ভিড় লক্ষ্য করা যায় তা অন্য সময় হয় না। ধনতেরাস উপলক্ষে দোকানগুলি কেনাকাটায় ছাড়, মজুরিতে ছাড় ও নানা ধরনের উপহার-এর ব্যবস্থাও করে। সবমিলিয়ে দু-দিকেরই একটা লাভ হয়। তা ছাড়া এই সোনার হাত ধরেই লক্ষ্মীকে এক বছরে জন্য ঘরে বেঁধে ফেলা হলো—এরকম একটা বিশ্বাস রয়েছে সবার মনে। সেটা যে নেহাত কম কিছু নয় তা ধনতেরাসের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা থেকেই বোঝা যায়। বাংলায় বাঙালির নতুন পার্বণ ঘিরে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*