শীতের ছুটিতে বেলুড় মঠ

কলকাতা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে হাওড়া থেকে ৬ কিলোমিটার যেতে গ্রান্ড ট্যাঙ্ক রোডে রামকৃষ্ণ মিশনের মূল দপ্তর শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ তথা বেলুড় মঠ অবস্থিত। ১৮৮৬ সালে প্রয়াত শ্রীরামকৃষ্ণের অস্থি ১৯৯৮ সালের ৯ ডিসেম্বর স্বামী বিবেকানন্দ কাঁধে করে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন বেলুড়ে। আর ১৯৩৬ সালে রামকৃষ্ণের জন্মশতবার্ষিকীতে শুরু হলো বেলুড় মঠ তৈরীর কাজ। পায় ৮ লক্ষ টাকা খরচ করে স্বামী বিবেকানন্দের পরিকল্পিত এই মঠ রূপ পায় সেই পুণ্যভূমে। এই মন্দিরের দৈর্ঘ্য ২৩৩ ফুট, প্রস্থ ১০৯ ফুটের মতো। পুরো মন্দিরটি লাল বেলেপাথরে তৈরি। এমন সুউচ্চ মন্দির পশ্চিমবঙ্গে বিরল। মঠের স্থাপত্যে বিশ্ব ভাতৃত্বের নিদর্শন মেলে। চার্চ, মসজিদ ও মন্দির এই তিনের সমন্বয়ে রূপ পেয়েছে বেলুড় মঠ। মঠের ভিতরে আছে বিশাল উপাসনা গৃহ। উত্তরদিকে বেদির উপর শ্বেত মর্মরে বসা অবস্থায় মূর্তি হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের। মঠটি পরিচালনা করেন স্বামী বিবেকানন্দের প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন। সারা বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন শাখায় রামকৃষ্ণ মিশনের বহু কর্মযজ্ঞ চলছে।

শ্রীরামকৃষ্ণের নিত্য পূজার্চনা, সন্ধ্যারতি, শ্রীরামকৃষ্ণ কীর্তন, শ্যামা সঙ্গীত ছাড়াও বিভিন্ন সাধন ভজনের আসর বসে। যাত্রীরাও আসেন বহু দূর দূরান্ত থেকে। ছুটির দিনগুলিতে বেলুড় মঠে রীতিমতো মেলা বসে। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা আবার বিকেল ৪ টে থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে বেলুড় মঠ।

মঠের পূর্ব দিক ধরে বয়ে চলেছে ভাগীরথী। ভাগীরথীর উত্তর পূর্ব পাড়ে বসবাস করতেন স্বামী বিবেকানন্দ। বেলুড় মঠের আরেক আকর্ষণ মূল প্রবেশ পথ জি.টি.রোডে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন সারদা মন্দির। সারদা মন্দিরের আরেক আকর্ষণ রামকৃষ্ণ দর্শন অর্থাৎ ছবি ও পুতুলে ঠাকুরের কথামৃত রূপ পেয়েছে। সোমবার ছাড়া প্রতিদিনই ৩ টাকার টিকিট কেটে দেখে নেওয়া যায়। মঠের অন্যতম আকর্ষণ ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স মিউজিয়ামের সহতায় গড়ে ওঠা শ্রীরামকৃষ্ণ মিউজিয়াম। রামকৃষ্ণ, সারদা, বিবেকানন্দ ছাড়াও নানান শিষ্যের বিভিন্ন সম্ভার তুলে ধরা হয়েছে এই মিউজিয়ামে।

মন্দিরটি জি.টি.রোডের ডানদিক থেকে বামদিকে প্রশস্ত। মঠ থেকে ১ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে লালবাবা কলেজের ডানদিকে মহাপ্রভু মন্দির, লালবাবা মঠ, রাসবাড়ির মতো কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। ভক্তরা বেলুড় মঠে এসে এগুলো দেখে নিতে পারেন বাস, রিকশায় চেপে বা পায়ে হেঁটে। কাছাকাছি অভিনব জাহাজ বাড়িটিও দেখে নিতে পারেন। চারপাশে জল আর তারমধ্যেই ইটে গড়া বাড়ি। অসম্ভব সুন্দর সেই জাহাজ। যা দেখলে সত্যিই চোখ ঘোরানো যায় না। প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাহাজ বাড়ি। রবিবার ও ছুটির দিনগুলোতে শুধুমাত্র সকাল ৯টা ও বিকেল ৬টায় খোলা থাকে বিশেষ বাড়িটি। বেলুড় মঠ থেকে নৌকায় চেপে গঙ্গা পেরিয়ে বরাহনগর বাজার পৌঁছে শ্রীরামকৃষ্ণ মহাশ্মশানটিতেও একবার ঘুরে আসতে পারেন। ফেরার পথে রতন বাবু রোডের উপর চন্দ্রকুমার রায় লেনের দশমহাবিদ্যা মন্দিরের কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী, কমলা দেবীকে একবার দর্শন করে নিতেই পারেন।এখানে একসময় নিয়মিত দেবী দর্শনে আসতেন শ্রীরামকৃষ্ণও। খুব কাছে কাশীপুর রোডে ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত উদ্যান বাটিটিও রামকৃষ্ণ ভক্তদের কাছে এক তীর্থস্থান।

এছাড়াও মালিপাড়ায় আছে পরমতীর্থ পাট বাড়ি। বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে এ এক বিশেষ ক্ষেত্র। মন্দিরটিতে গৌর নিতাই ছাড়াও শ্রীগৌরাঙ্গ গ্রন্থ মন্দির ও বৈষ্ণব মিউজিয়াম আছে। শ্রীচৈতন্যদেবের হস্তাক্ষরও দেখে নিতে পারেন মিউজিয়ামে।

এবার ভ্রমনার্থীদের জন্য কিছু টিপসঃ

যদি বেলুড় মঠে যাওয়ার প্ল্যান থাকে তাহলে এই বিষয়গুলো একটু মাথায় রাখলে সুবিধা হবে। সকাস সকাল আদ্যাপীঠে পৌঁছে সারাদিন ঘুরে বাড়ি ফিরে আসাটা কিন্তু খুব একটা অসম্ভব নয়। তবে ক্লান্ত হয়ে পড়লে দুভাগে ঘোরাটাকে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দক্ষিনেশ্বর ও আদ্যাপীঠ একই দিনে বেড়িয়ে সেকেন্ড হাফে বেলুড় ও বালি ঘুরে নিলে সুবিধা হবে। আদ্যাপীঠ, দক্ষিণেশ্বর, বেলুড় সর্বত্রই খুব অল্প টাকার বিনিময়ে অন্নপ্রসাদের কুপন মিলতে পারে। সকাল ৯টার মধ্যে কুপন সংগ্রহ না করলে এই সুবিধা পাওয়া যাবে না।

বেলুড় মঠে উৎসবঃ

সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয় বেলুড় মঠে। ফাল্গুন মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ৩ দিন ধরে মহাসমারোহে ঠাকুরের আবির্ভাব উৎসব পালিত হয়। আতসবাজিও পোড়ে অনুষ্ঠানের শেষ সন্ধ্যায়। এই উৎসব খুবই আকর্ষনীয়। উৎসবের দিনগুলিতে বেলুড় মঠে দেশ বিদেশের বহু ভক্ত সমাগম হয়। এছাড়াও কালীপুজো, স্নানযাত্রা, দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো এবং শিবরাত্রি উৎসবও মহাসমারোহে বেলুড় মঠে পালিত হয়।

কীভাবে যাবেনঃ

দক্ষিণেশ্বর থেকে ৫১ বা ৫৬ রুটের বাসে বা নৌকায় চেপে বেলুড় মঠে পৌঁছে যাওয়া যায়। এছাড়াও হাওড়া স্টেশন থেকে বহু বাস জি.টি.রোড ধরে বেলুড় মঠে পৌঁছে যাচ্ছে। আছে লোকাল ট্রেনও। হাওড়া স্টেশন থেক ট্রেনে চেপে মাত্র আধ ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় বেলুড় মঠ।

কোথায় থাকবেনঃ

থাকার জন্য বেলুড় মঠে বিভিন্ন দামের হোটেল ও গেস্ট হাউস পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে হোটেল শিবম, মধুমিলন গেস্ট হাউস, সভাশ্রয় গেস্ট হাউস, হোটেল মেঘদূতের মতো বহু হোটেল আছে বেলুড় মঠের কাছাকাছি।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*