কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনে চাঁদের হাট, চলচ্চিত্রে সুরের প্রভাব নিয়ে অমিতাভ বচ্চন বললেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা

পিয়ালি আচার্যঃ একবছরের প্রতিক্ষার অবসান। যৌবনে পা দেওয়া কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঔজ্জ্বল্যে ছাপিয়ে যেতে পারে বিশ্বের যে কোনো চলচ্চিত্র উৎসবকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ভারতের যে কোনো চলচ্চিত্র উতসবের মধ্যে সেরা। আর চলচ্চিত্র উতসব কমিটির চেয়ারপার্সন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের এই বক্তব্য যথার্থ যে, বাঙালীর ১২ মাসে এখন আর ১৩ পার্ব্বণ নেই, এখন মাসে ১৪ পার্ব্বণ। সেই ১৪ তম পার্ব্বণ হল কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব। নক্ষত্র সমাবেশ বললে বড় কম বলা হয়। বলা যায় নক্ষত্রের চোখ ধাঁধানো আলোয় অথবা বলা যায় হীরক দ্যুতিতে ঝলমল করছিল গোটা ইন্ডোর। অনুষ্ঠানের সূচনা হল রশিদ খান, তেজেন্দ্র নারায়ন ও বিক্রম ঘোষের সমবেত পরিবেশনা দিয়ে। সূচনাই বুঝিয়ে দিল অনুষ্ঠান কোন মাত্রায় পৌঁছচ্ছে। শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৪টেয় আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন হল ২৩ তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব। প্রদীপ জ্বালালেন অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, কাজল, কামাল হাসান, মহশে ভাট, কুমার শানু এবং মাইকেল উইন্টারবটম। ভিড়ে ঠাসা ইন্ডোরে তখন উচ্ছ্বাস তুঙ্গে। মঞ্চে ওঠার সময়ই অমিতাভ বচ্চনকে উত্তরীয়, উপহার ও দুর্গা ঠাকুরের পটচিত্র দিয়ে সংবর্ধনা জানান প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। এরপর একেএকে দেব শাহরুখ খানকে, শুভশ্রী কামাল হাসানকে, কোয়েল মহেশ ভাটকে, ইন্দ্রানী হালদার কাজলকে এবং পাওলি দাম উইন্টারবটমকে সম্বর্ধিত করেন। কাজল, মহেশ ভাট, কামাল হাসান প্রত্যেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উদ্দ্যমের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কাজল এক কদম এগিয়ে বলেন- কলকাতা আমি তোমাকে ভালোবাসি।

এরপর বলিউডের বাদশাহ শাহরুখ খান বলতে শুরু করেন। নেতাজী ইন্ডোরে তখন যেন সমুদ্রের গর্জন। মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি মার্ভেলাস, ক্রিয়েটিভ, ওয়ান্ডারফুল পার্সন বলে উল্লেখ করেন। শাহরুখ বাংলা শিখেছেন এই বলে তিনি গড়গড় করে বাংলায় বললেন এই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে উপস্থিত থেকে সম্মানিত বোধ করছি। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এই শহর এবং অবশ্যই দেশের সবচেয়ে মিষ্টি শহর কলকাতা। সকলকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি তিনি বলেন পরের বার ধুতি পরে আসব। হৃদয়ের অন্তরস্থল থেকে ধন্যবাদ জানান মুখ্যমন্ত্রীকে। শাহরুখ বলেন, কলকাতা শহরটাকে এখন খুব সুন্দর লাগছে, কিন্তু মমতা বন্দোপাধ্যায় তার থেকেও সুন্দর।

এবার এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রতিবছর চলচ্চিত্র প্রেমীরা যার বক্তব্য শোনার জন্য মুখিয়ে থাকেন সেই অমিতাভ বচ্চন এলেন বক্তব্য পেশ করতে। প্রতিবছরই চলচ্চিত্র জগতের কোনও একটা বিষয় নিয়ে অত্যন্ত মনোজ্ঞ ভাষণ দেন অমিতাভ। এবছরও তার ব্যতিক্রম হলনা। ব্যারিটন ভয়েসে বিগ বি বাংলায় বললেন, আমি আপনাদের জামাইবাবু আবার এসেছি। আপনাদের নমস্কার। বললেন বারবার মমতাদিকে বলি আমাকে আর আমন্ত্রণ জানাবেন না। আমি এই নিয়ে সম্ভবত ৪বার এলাম। কিন্তু মমতাদি বলেন আসতে, আর আমি আসতে বাধ্য হই। বিযয়ে প্রবেশ করলেন অমিতাভ। এবারে তাঁর বক্তব্যের বিষয় মোলোডি, অর্থাৎ ভারতীয় চলচ্চিত্রে সুরের প্রভাব। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে তিনি স্মরণ করে বললেন, গানে গানে মোর সুরের আসন খানি, পাতিপথের ধারে ওগো পথিক ওগো পথিক। এরপর একেএকে রায়চাঁদ বড়াল, কে এল সেহগেল থেকে শুরু করে লতা, আশা, মুকেশ, হেমন্ত, রফিক, কিশোর দের কথা উঠে আসে বিগ বির বক্তব্যে। এরপর বাঙালীরা যেমন ইলিশ মাছ-ভাত খেতে ভালোবাসেন তেমনই গান হয়ে উঠেছিল বাঙালীর অত্যন্ত পছন্দের বিষয়। এরপর শচীন দেব বর্মণ, সলিল চৌধুরী, রাহুল দেব বর্মণ থেকে শুরু করে হাল আমলের এ আর রহমান , শান্তনু মৈত্রের সৃষ্টির কথা উল্লেখ করে তাক লাগিয়ে দেন দর্শকদের। গেয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত রবীন্দ্র সঙ্গীত যদি তারে নাই চিনি গো, মন মোর মেঘের সঙ্গীত, তোমার হল শুরু আমার হল সারা ও পরিনীতা ছবি থেকে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে। কিন্তু বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে গানের মাধ্যম, সুরের মাধ্যমে গান যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে বার্তা বহন করে সেকথাই বললেন তিনি। বাদায়নীর লেখা কৃষ্ণের ভজন এটাই তো আমাদের দেশের ঐতিহ্য। এটাই তো আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপণ। চলচ্চিত্রে বাকস্বাধীনতার পক্ষে এবং সেন্সর বোর্ডের অতি সক্রিয়তার বিরুদ্ধে সরব হন পরিচালক মহেশ ভাট। রাজ্য সরকারের এই চলচ্চিত্র উৎসবে মমতা বন্দোপাধ্যায় ছিলেন হোস্ট। এবারের কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের পার্টনার ইউ কে বা ইউনাইটেড কিংডম।

পাশাপাশি এদিন উইন্টারবটমের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী বলেন ছোট কিন্তু ভালো হৃদয়। হলিউড, বলিউড, টলিউডকে সব আমরা এই উৎসবের মধ্য দিয়ে একসাথে করেছি। এতবড় পর্দায় কোথাও ছবি দেখানো হয়না। এরপর ছবি দেখানো হবে হলে, ছড়িয়ে পড়বে সারা বাংলায়। মমতা বলেন অমিতাভজি ঠিকই বলেছেন সারা বিশ্ব আজ মায়ের আঁচলে এসেছে। চলচ্চিত্র উৎসবেরে সার্বিক সাফল্য কামনা করেন তিনি। এরপর উদ্বোধনী চলচ্চিত্রে দেখানো হয় ইরানের মোস্তাফা পাখিজাদের ইয়েলো। এককথায় বলা যায় যারা ছবিটি দেখলেন না মিস করলেন। বিভিন্ন সম্পর্ক, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং বিশেষ করে মানুষের ভালোবাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছবিতে। জয় হয়েছে মানবিকতার, আবেগের, মানুষের অন্তরের সুন্দর দিকগুলির।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*